পিছনে শুধু একটি কাঠের অথবা প্লাইউডের পাটাতন। তার উপরে রিলিফ ওয়ার্কে ক্রমশ ফুটে উঠছে প্রতিমার অবয়ব। এভাবে নানা মূর্তি তৈরি করেন শিল্পীরা। তাই বলে সেই মূর্তি পুজো করাও যায়? সেদিন সত্যিই অবাক লেগেছিল এমন একটা কথা শুনে। পুজো উদ্যোক্তাদের উপর চটে উঠেছিলেন কেউ কেউ। তখন ১৯৫৯ সাল। বাংলার ঘরে ঘরে তখনও দুর্গা পুজোয় শুধুই সাবেকি প্রতিমা। এই প্রথম বৈচিত্র্য এল জগত মুখার্জি পার্কের পুজোয়।
“এবছর সেই ৬১ বছর আগের মণ্ডপ এবং প্রতিমাকেই ফিরিয়ে আনছি আমরা। আমাদের এবছরের থিম, ‘কলকাতার থিম পুজোর শুরু’”, বলছিলেন পুজোর আহ্বায়ক দ্বৈপায়ন রায়। হ্যাঁ, কলকাতার থিম পুজোর শুরু নিয়ে বিতর্কের অংশীদার জগত মুখার্জি পার্কের পুজোও। এর আগে মণ্ডপ সজ্জাতে নানা পরীক্ষা হলেও প্রতিমার সাবেক চেহারা বদলাতে সাহস পাননি কেউই। শিল্পী অশোক গুপ্ত বদলে দিলেন পুরোটাই। এমনকি মূর্তি তৈরির ঘরানা পর্যন্ত।
“অনেকেই সেই পরীক্ষা মানতে চাননি। আমাদের পুজো বয়কট করার ডাকও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের জনপ্রিয়তায় অন্যান্য পুজোগুলিও একই পথে হাঁটল।” অবশ্য দ্বৈপায়ন বাবু মনে করেন আজকের দিনে থিম পুজোর সংজ্ঞার সঙ্গে সেদিনের সেই পুজো মেলে না। “কিন্তু প্রতিমা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না হলে পরে থিম পুজোর ধারণাই আসত না। তাছাড়া এই জগত মুখার্জি পার্কেই পরে নানা ধরনের থিমের জন্ম দিয়েছেন শিল্পী অশোক গুপ্ত। তার মধ্যে ছিল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে বানানো প্রতিমা। তারপর সত্তরের দশকেই যুদ্ধ-বিরোধিতার থিমে প্রতিমার চেহারা করা হয়েছিল পরমাণু বোমায় বিধ্বস্ত এক মায়ের মূর্তি। আর সেই সব মূর্তিই অশোক গুপ্ত তৈরি করতেন ওই কাঠের পাটাতনের উপর মাটির রিলিফ ওয়ার্কে।”
এবারেও একইভাবে তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। সারা মণ্ডপ জুড়েই সাজিয়ে তোলা হচ্ছে ৬১ বছর আগের দৃশ্য। “তবে অশোক গুপ্তর কাজকে অনুকরণ করা সম্ভব নয়” দ্বৈপায়ন রায় বলছিলেন, “আমরা তাঁকে অনুসরণ করতে পারি শুধু।” জগত মুখার্জি পার্কের পুজো ঠিক কত পুরনো, সেকথা পুজোর উদ্যোক্তারাও বলতে পারলেন না। কেউ সেই হিসাব রাখেননি। তবে স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই পুজো চলে আসছিল। এলাকার তরুণরাই চাঁদা তুলে পুজোর আয়োজন করতেন। বাজেট ছিল কম। কিন্তু সেই কম বাজেটেই যে বাজিমাত করেছিলেন তাঁরা। ১৯৫৯ সাল থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি পুজো কর্তৃপক্ষকে। প্রতিযোগিতা নয়, বরং নিজেকেই বারবার ছাপিয়ে যেতে বিশ্বাসী জগত মুখার্জি পার্ক। আর সেই এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় টুকরো কিছু স্মৃতি ধরা থাকছে এই ২০২০ সালে। যদিও দর্শকবিহীন এই পুজোর কথা সত্যিই ভাবতে পারননি উদ্যোক্তারা। এখন কীভাবে এই উদ্যোগকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা যায়, সেই চেষ্টাতেই ব্যস্ত, এই সপ্তমীর সন্ধেতেও...
Powered by Froala Editor