দীর্ঘদিন ধরেই লাগামছাড়া শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল সমগ্র ছোটনাগপুর জুড়ে। সাঁওতাল, খেড়িয়া (শবর), মুণ্ডা, মাহালি, কড়া, বিরহড় সবাই যেন অপেক্ষাতে ছিলেন। ঠিক সেই সময়ই শালের ডাল নিয়ে বহুপ্রতীক্ষিত বার্তাটি এল। ভগনাডিহির জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামে সিধু, কানহু, চাঁ, ভৈরো মুর্মুরা ডাক দিয়েছেন সমাবেশের। হাজার হাজার আদিবাসী পুরুষ মহিলা সেখানে সম্মিলিত হলেন ৩০ জুন। সালটা ১৮৫৫। শাল, পলাশ, মহুয়ার ঘন সবুজ জঙ্গল ছড়িয়ে হুঙ্কার ওঠে - হুল! হুল! সহস্র মাদল ধমসায় একযোগে বেজে ওঠে যুদ্ধের ডাক, কিন্তু কেন?
ব্রিটিশরা তো ছিলই, সঙ্গে দেশীয় মহাজন, জমিদার, সবাই মিলে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। কী নেই সেই তালিকায়! প্রকৃতির কোলে নির্বিবাদে নিজেদের মতো বেঁচে থাকা আদিবাসীদের নিজের হাতে খেটে জঙ্গল থেকে তৈরি করা কৃষি জমি দখল, অত্যধিক হারে খাজনা আদায়, জমিদার, মহাজনদের ঋণের ফাঁদে ফেলে গৃহপালিত পশু ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া থেকে প্রজন্ম ধরে বেগার খাটানো, ঠকানো, মা-বোনেদের সম্মানহানি, নিত্যনৈমিত্তিক পুলিশি অত্যাচার, কাজ করিয়ে বেতন না দেওয়া, প্রতিবাদ করলে ব্রিটিশ পুলিশের নির্মম অত্যাচার, জেল, নির্বিচার হত্যা, এমনকি বাজার থেকে সামান্য লবণ কিনতে গেলেও তাঁদের বেশি ওজনের বাটখারা দিয়ে ঠকানো হত! আবার তাঁদের কাছ থেকে ধান, সবজি কেনার সময় কম ওজনের বাটখারা দিয়ে বেশি পরিমাণে সব নেওয়া হত!
সেই সমাবেশে সিদ্ধান্ত হয় রুখে দাঁড়ানোর। ঠিক করা হয়, ব্রিটিশদের রাজধানী কলকাতা গিয়ে প্রতিবাদ করা হবে। বার্তা ছড়িয়ে যায়, পলাশ, মহুল, ডুংরিঘেরা ছোটনাগপুর জুড়ে ধমসা মাদলের রণদুন্দুভির নির্ঘোষে উচ্চারিত হয় -
হুল! হুল!
আরও পড়ুন
গুপ্তচর সন্দেহে জেলবন্দি; ’৬২-র যুদ্ধে যেভাবে ‘বেঁচে’ ছিলেন অসমের চা-বাগানের কুলিরা
মিছিল শুরু হয়। বাকি ভারত তখনও ব্রিটিশের তাঁবেদার...
ভারতের প্রথম স্বাধীনতার জন্য ডাকও এটাই। শুরু হয় লং মার্চ, ভগনাডিহ থেকে কলকাতার পথে এগিয়ে চলে মিছিল। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকাও তখন এই বিদ্রোহের পক্ষে নেই।
আরও পড়ুন
জেরুজালেম ঘিরে ইহুদি ও রোমানদের দ্বন্দ্ব, ১৯০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই বিরল মুদ্রা
পথে বিদ্রোহীদের গ্রেফতার করতে আসেন মহেশ দত্ত, দারোগা। তাঁর ছিন্নমুণ্ড নিয়েই অগ্রসর হয় মিছিল। আরও সতেরো জন মহাজন, সুদখোরও বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। ব্রিটিশরা সৈন্য নামান, বিদ্রোহ দমনে।
আরও পড়ুন
আফ্রিকান ক্রীতদাস থেকে দাক্ষিণাত্যের ‘কিং মেকার’, আওরাঙ্গাবাদের প্রতিষ্ঠাতা মালিক অম্বর
গেরিলা যুদ্ধ চলে। প্রায় আটমাস বিদ্রোহীরা লড়ে গেছেন দেশমাতৃকার পরাধীনতা মোচনে। অসম্ভব নির্মমতার সঙ্গে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়, প্রায় তিরিশ হাজার আদিবাসীকে হত্যা করা হয়। ভারতবর্ষে প্রথম সামরিক আইন জারি হয় এই বিদ্রোহকে দমন করতে। সিধুকে গুলি করে খুন করা হয়, কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর বাকি দুই ভাই, চাঁদ ও ভৈরোও অসমযুদ্ধে মারা যান। তাঁদের বোন ফুলো মুর্মুর ধর্ষিত, গুলিবিদ্ধ দেহ ফেলে রাখা হয় জামশেদপুর রেললাইনে!
হুল দিবস কোনো উৎসব নয়, হুল দিবস এই ভারতের ভূখণ্ডের পাহাড়, জঙ্গলে বাস করা, প্রকৃতির মাঝে বেঁচে থাকা অকৃত্রিম আদিম জনজাতির আত্মোৎসর্গের স্মরণদিবস।
যে গুরুত্ব দিয়ে ক্ষুদিরামের নাম উচ্চারিত হয়, সেই গুরুত্ব দিয়ে সিধু, কানহু, চাঁদ, ভৈরোর নাম উচ্চারিত হোক। যে শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাতঙ্গিনী হাজরার নাম উচ্চারিত হয়, সেই শ্রদ্ধার সঙ্গেই এই বিদ্রোহী ভাইদের দুই লড়াকু বোন ফুলো ও ঝানো মুর্মুর নামও স্মরণ করা হোক।
কর্পোরেট সেক্টরের ইচ্ছেমতো আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গল কেটে রিসর্ট, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, কারখানা তৈরি বন্ধ হোক। মাওবাদী সন্দেহে ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ডের নিরীহ আদিবাসী যুবকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হোক।
হুল দমনপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার। শাল, পলাশ, মহুল আকীর্ণ পাহাড়ঘেরা গ্রামগুলো থেকে যে কোন সময় সিধু কানহু-রা ধমসা মাদলের বজ্রনির্ঘোষে হুলের আহ্বান দেবেন। এই বিশ্বাস আদিবাসীদের, আমাদেরও। আসুন রক্ষা করি, সম্মান করি, মর্যাদা দিই ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের আদিম অধিবাসীদের। আমরা আর্যরা কিন্তু তাঁদেরই মাটিতে আশ্রিত।
Powered by Froala Editor