বাংলার মসনদে তখন নবাব আলিবর্দি খান। বাংলা জুড়ে শুরু হয়েছে মারাঠা সেনা বা বর্গিদের আক্রমণ। বর্গিরা লুটপাট করে গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে এগিয়ে চলছে আবারও নতুন এলাকার খোঁজে। নবাব আলিবর্দি খানও হাত গুটিয়ে বসে নেই। তিনি বৃদ্ধ বয়সেও তার সর্বশক্তি লাগিয়েছেন বর্গি দমনে। নিজে বীরপরাক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বর্গিদের সাথে যুদ্ধ করতে তাকেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।
কাশিমবাজার তখন পূর্ব ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর। দেশি-বিদেশি বহু বণিকদের ভিড় লেগেই থাকত এখানে। শহরের রেশম ব্যাবসাও বেশ ফুলে ফেপে উঠেছিল। সব কিছু বেশ ভালোই চলছিল। এমন সময় এক গুজব রটল বর্গিরা ধেয়ে আসছে কাশিমবাজার আক্রমণ করতে। এখবর শুনে শহরবাসীদের অনেকেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কাশিমবাজার ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিল। বর্গি হামলার ভয়ে ভীত মানুষ গুলির অধিকাংশই ছিল তাঁতি এবং কাপড় ব্যাবসায়ী। এরা প্রত্যেকেই শহর ছেড়ে অন্যত্র বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ স্থানের খোঁজ করছিল। বহু খোঁজা-খুঁজির পর অবশেষে তারা এসে উঠেছিল পদ্মার শাখা নদ ভৈরবের তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ ইসলামপুরে।
ইসলামপুরে এসে তাঁতিরা বসবাসের জন্য বেছে নেয় ভৈরব নদের তীরবর্তী এলাকা। যার তিন দিকই ছিল ভৈরব নদ দ্বারা বেষ্টিত। ফলে এখনে তাঁতিরা নিরাপত্তার কোনো অভাব বোধ করেনি। অন্যদিকে এই অঞ্চলে বর্গি আক্রমণের তেমন কোনো সম্ভবনাও ছিল না। ফলে কাশিমবাজার থেকে আগত তাঁতিদের বেশ সুখ-সাচ্ছন্দেই দিন কাটছিল।
ইসলামপুরে এসে তাঁতিরা আবার তাদের পুরানো পেশায় ফিরে গেল। ইসলামপুরের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি থেকে খুব সহজেই রেশম শিল্পের কাঁচামাল আসায় তাঁতিদেরও খুব সুবিধে হল। এবং তাঁতিদের গড়ে তোলা নতুন বসতিতে গড়ে উঠল রেশমের বাজার। জনমুখে ইসলামপুরের এই নতুন বসতি পরিচয় পায় 'চক’ নামে। ‘চক’ একটি পার্শি শব্দ যার অর্থ বাজার।
আরও পড়ুন
প্রতিদিন খেজুর গাছে উঠে রস সংগ্রহ, ‘সিঙ্গল মাদার’ সাবিত্রীর লড়াই
এদিকে পার্শবর্তী বিভিন্ন এলাকার রেশম ব্যাবসায়ীরা চক থেকে কাপড় কিনে দেশ এবং দেশের বাইরে বিক্রি করতে শুরু করলে তৎকালীন সময়ে ইসলামপুরের চক দেশের অন্যতম রেশম শিল্প কেন্দ্র হিসেবে পরিচয় পেল। ধীরে ধীরে চক গ্রামের শ্রীবৃদ্ধি ঘটল। বাড়ল জনসংখ্যাও।
আরও পড়ুন
রাঢ় বাংলার অঘ্রাণ ও গ্রামে-গ্রামে বৈষ্ণবীয় ভোরাই 'টহল'
এভাবেই কেটে যায় বহু বছর। এই দীর্ঘ সময়ে পালটে যায় দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। নবাবি আমল শেষ হয়ে আসে ইংরেজ আমল। নিরীহ দেশবাসীর উপর ইংরেজদের শোষণ নীতির ফলে শুরু হয় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনে ইসলামপুরের-চকের জনগনও সামিল হয় বিভিন্ন সময়। যার বহু প্রমাণ আজও রয়ে গেছে। এর মধ্যেই বিংশ শতকের প্রথমদিকে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে চক গ্রামের চন্দ্রকান্ত সাহা ইসলামপুরে খাদি আন্দোলন শুরু করেন। সেই থেকেই চকে রেশমের সাথে খাদি শিল্পও খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন
উঠে গেল হ্যান্ডলুম ও হ্যান্ডিক্রাফট বোর্ড, দুশ্চিন্তায় দেশের লক্ষ লক্ষ তাঁতি পরিবার
তারপর পার হয়েছে আরও কিছু সময়। কালের করালগ্রাসে আজ সব কিছুই ধ্বংশ হতে বসেছে। ভৈরব নদ তার স্রোত হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। অন্যদিকে একদা দেশ ও বিদেশ খ্যাত চক-ইসলামপুরের রেশম-খাদি শিল্পও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে আজ মৃত্যুশয্যায়। তাঁতিদের এই গ্রামে আজ তাঁতিরাই যেন ব্রাত্য হয়ে গেছে। এই পেশায় এখন না আছে সম্মান না আছে অর্থ। তাই অধিকাংশ তাঁতিই এই পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। এখন চক গ্রামের সামান্য কিছু তাঁতি পরিবারই শুধুমাত্র আবেগের তাড়নায় এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছে তিন চার পুরুষ কিম্বা তারও বেশি সময় ধরে। তাদের সঙ্গে কথা বললে তাদের কথায় ঝরে পড়ে তাদের কষ্টের কথা, অসহায়ত্বের কথা। তাঁতিদের জন্য সরকারি সাহায্য থাকা সত্ত্বেও তারা সেগুলি কোনোদিনই ঠিক মতো পায়নি বলে অভিযোগ। ফলে তাঁতিদের পরিবারে অভাব-অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। বর্তমানে চক গ্রামের পূর্ব গৌরব অস্তমিত হলেও, আজও গ্রামের অলি-গলি পথ দিয়ে চলার সময় হস্ত চালিত কাপড় বোনা যন্ত্রের ‘ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট’ শব্দ মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় চকের গৌরবময় অতীতে।
আরও পড়ুন
অবশেষে কাজের স্বীকৃতি, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাচ্ছেন নদীয়া তাঁতশিল্পী সরস্বতী সরকার
Powered by Froala Editor