স্বল্পমূল্যে একের পর এক চিরায়ত সাহিত্য; বইপাড়ার ‘ডার্ক হর্স’ রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের গল্প

বইপাঠক বাঙালির সংখ্যা কমে আসছে প্রতিদিন। বইয়ের বাজার আজকাল আর তেমন ভালো নয়। বাজারের মন্দার সঙ্গে টেক্কা দিতে প্রকাশকরাও বইকে হাজির করছে নানা অভিনব মোড়কে। লেখক আর প্রকাশককে নিয়ে আর বইকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গোটা একটা কারখানা। কিন্তু তার মাঝেও যাঁরা বই পড়ার পুরনো অভ্যেসকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন, বই এখনও তাঁদের কাছে নির্ভেজাল পাঠ্যবস্তু। কিনলাম, পড়লাম, রেখে দিলাম— বইয়ের সঙ্গে এই ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে তাঁরা একই বইকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়েন। আর হাতে গোনা বাঙালি পাঠকের মধ্যে তাঁরাই কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ। রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের ম্যানেজার গোরাচাঁদ অধিকারী তাই বলেছিলেন, "নতুন লেখকদের বই এক ধাক্কায় খানিকটা বিক্রি হয়ে যায়। তবে ধারাবাহিকভাবে ক্লাসিক বইয়ের বিক্রিই বেশি।"

হ্যাঁ, বাংলায় ক্লাসিক বইয়ের কথা বললেই তো মনে পড়ে রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের কথা। সেই ষাটের দশকে পথচলা শুরু। তারপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে পরম নিষ্ঠায় ক্লাসিক বইয়ের চর্চা করছেন তাঁরা। নতুন প্রকাশনা অবশ্য হাতে গোনা কিছু আছে। তবে মূলত উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথম চার দশকের প্রবাদপ্রতিম লেখকদের উপরেই ভরসা রেখেছে রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন। এই সময়ের প্রায় সমস্ত সাহিত্যিকের সমগ্র এবং রচনাবলী প্রকাশ পেয়েছে রিফ্লেক্ট থেকে। প্রকাশিত হয়েছে মধ্যযুগের কাব্য নিয়ে 'চিরায়ত সাহিত্য সংগ্রহ'। তবে হার্ড বাইন্ডিংয়ের মোটা বইয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু ছিমছাম পকেট সাইজের বইও প্রকাশিত হয়েছে রিফ্লেক্ট থেকে। এর মধ্যে আছে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উপন্যাস, নাটক ও গীতিনাট্য। "রবীন্দ্রনাথের বইয়ের মধ্যে এগুলোর চাহিদাই বেশি", বক্তব্য গোরাচাঁদবাবুর। তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের বেশ কিছু উপন্যাসও পকেট সাইজে প্রকাশিত হয়েছে।

পকেট-সাইজ সিরিজ, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন

 

পূর্বপ্রকাশিত বইয়ের কপিরাইট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই প্রকাশ করে রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন। তবে বেশ কিছু নতুন প্রকাশনার কাজও করেছেন তাঁরা। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য শ্যামল বসুর লেখা সুভাষচন্দ্রের জীবনী বিষয়ক 'সুভাষ ঘরে ফেরে নাই'। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উপলক্ষে রিফ্লেক্টের পক্ষ থেকে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের রচনা সংগ্রহ। আসলে ক্লাসিক সাহিত্যের মধ্যে দিয়েও একভাবে সমকালকে ধরতে পেরেছিল এই প্রকাশনা সংস্থা। আর বাংলা প্রকাশনা জগতে প্রথম মহিলা প্রকাশকের নামটাও সম্ভবত রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের সঙ্গেই যুক্ত। নব্বইয়ের দশকে রিফ্লেক্ট কর্তৃক প্রকাশিত সমস্ত বইতে লেখা থাকত, প্রকাশক বুলবুল বসু।

আরও পড়ুন
বিপ্লবীর পরামর্শে শুরু প্রকাশনা, শতবর্ষের দোরগোড়ায় কলকাতার ডি এম লাইব্রেরি

দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশনার জগৎ দাপিয়ে বেড়িয়েছে রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন। নব্বইয়ের দশকে তো রমরমা বাজার। কিন্তু বইয়ের মন্দা বাজার ছায়া ফেলেছে সর্বত্র। মহাত্মা গান্ধী রোডের উপর একটি বাড়ির দোতলায় তিন চারটে ঘর নিয়ে প্রকাশনার অফিস। আগের দিনের ব্যস্ততার কিছুমাত্র আর নেই। জলে ভিজে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে কাঠের সাইনবোর্ড। শেষ বইটাও প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'। বইমেলাতেও আর স্টল বসে না গত চার পাঁচ বছর। তবে এখনও বাজারে ক্লাসিক বইয়ের চাহিদা যথেষ্ট। গোরাচাঁদবাবু তাই বলছিলেন, "বাজার খারাপ। তবু বিক্রিবাটা যা হয় তাতে একটা ব্যবসা বেশ চলে যায়।"

তবে নিছক ব্যবসায়ী পরিচয়ের বাইরে বেরিয়েও পৃথক একটি পরিচয় আছে রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের। সমকালের সঙ্গে মিলিয়ে ঐতিহ্যের একটি প্রতিফলন ঘটানোর অঙ্গীকার নিয়ে জন্ম নিয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান। সেইসব বইয়ের সঙ্গে যে বাংলার সংস্কৃতির নাড়ির টান। সেই শিকড় ছিঁড়ে গেলে আমাদের অস্তিত্ব বাঁচবে তো?

আরও পড়ুন
বদলাচ্ছে পাঠকের রুচি, ব্যাতিক্রমী বইয়ে নজর ব্রিটেনের তিন প্রকাশনা সংস্থার

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More