এক্সাইড মোড় ছাড়িয়ে এলগিন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক বাঁ হাতে একটা সরু অন্ধকার গলি ঢুকে গিয়েছে। কাছেই ‘লক্ষীবাবু’র সোনার দোকান। এমন ভুলভুলাইয়া গলির শেষ প্রান্তে কী অপেক্ষা করছে, তা বাইরে থেকে ঠিক ঠাহর হবে না। বেলা প্রায় দেড়টা। তবুও গলির মধ্যে সূর্যের আলো ঢোকে না। দুপাশে সাবেকি বাড়ি। সবমিলিয়ে অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ। খানিকক্ষণ বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকি গলির সামনে। ঠিক জায়গায় পৌঁছেছি তো? পরমুহূর্তেই দেখি, ভরদুপরে দুই কলেজ পড়ুয়া প্রেমিক-প্রেমিকা ধাঁ করে সেঁধিয়ে গেল গলির মধ্যে। কপোত-কপোতীর পিছু নিলাম নিঃশব্দে। মনে চাগাড় দিচ্ছিল অপরাধবোধ। যদি দেখে ফেলে? কেলেঙ্কারি হবে তাহলে।
গলি ধরে সেকেন্ড দশেকের মধ্যেই বাঁ দিক ঘুরেই ধুলোমাখা সাইনবোর্ড। ছোট্ট রেস্তোরাঁ। ‘টিবেটান ডিলাইট।’ প্রায় অন্ধকার ঘর। শুধু লাল চিনে লণ্ঠনের জাদুটোনা। অনেকটা ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ সিনেমার একটি দৃশ্যের মতো। যে দৃশ্যে ভিলেনের ঘরে ড্রাগ তৈরি হচ্ছিল। তেমনটাই। একেবারেই নীহাররঞ্জন গুপ্তের কোনো গপ্পের প্রেক্ষাপট যেন। ছোট ছোট দু তিনটি চেয়ার টেবিল। তার একটিতেই ‘কপোত-কপোতী’ গল্প জুড়েছেন। এককোনে ক্যাশ কাউন্টার। দেওয়ালে টাঙানো চিনা অক্ষর। মেনুকার্ডে চোখ রেখে চমকে উঠলাম…
‘মোমো আই এম’, কিংবা ‘ওয়াও মোমো’ তখনও শহরে আসেনি। রাস্তায় রাস্তায় স্টিম মোমোও বিরল। কলেজ পড়ুয়াদের ঠিকানা তখন টিবেটান ডিলাইট। চিনে খাবার টু মোমো-থুকপা সবই মিলবে। কিন্তু গড়পড়তা মোমোর থেকে স্বাদে আলাদা। যেন ময়দা মোড়া একটুকরো দার্জিলিং। টিবেটান ডিলাইট-এর জন্ম ১৯৯৩ সালে। জিৎবাদল মুখিয়া এবং তাঁর পুত্র উদয় মুখিয়ার হাত ধরে শুরু হল ব্যবসা। উদয়ের প্রপিতামহ দার্জিলিং-এর মানুষ। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম-র জন্মকর্ম এই শহরেই। বাবা-ছেলে দু'জনেই গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন। এখন দোকানের দায়ভার জিৎবাদলের পুত্রবধূ নিমা মুখিয়ার হাতে। নাতনি, অমৃতাও দেখেন মাঝে মাঝে। তাঁর সঙ্গেই জমে উঠছিল কথোপকথন।
আরও পড়ুন
আধুনিকতার যুগে ব্রাত্য তারা, শতাব্দীপ্রাচীন স্মৃতি নিয়ে ধুঁকছে কলকাতার ‘সি ব্রস স্টুডিও’
‘আমরা ইচ্ছে করেই খাবারের দাম বাড়াই না। এটা কলেজ পড়ুয়া, অফিস-গোয়ারদের খুব প্রিয় জয়েন্ট।’ ঝরঝরে বাংলায় বলছিলেন অমৃতা। ১৫ আগস্ট-এর দু'দিন পর থেকে আবার খুলেছি। মাঝে লকডাউনে চারমাস বন্ধ রেখেছিলাম।’
‘লোকসান?’
আরও পড়ুন
রোজ সাইকেলে কলকাতা, মাত্র ৫ টাকায় মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন রানাঘাটের যুবক
অমৃতার কণ্ঠে ঝরে পড়ে আত্মবিশ্বাস।
‘দেখুন, আমাদের এই দোকান খুব ক্ষতির মুখ দেখেনি। অত প্রচার নেই। কিন্তু যাঁরা খাদ্যরসিক তাঁরা জানেন আমাদের কথা। কলকাতায় আমাদের খদ্দেরের অভাব হয় না।'
আরও পড়ুন
২৩০ বছর পেরিয়ে, কেমন আছে 'ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব'?
কথা বলতে বলতে চলে এল একপ্লেট চিকেন ‘কোথে’। ‘কোথে’ হল একপাশে হাল্কা ভাজা, অন্যপাশে স্টিমড মোমো। মুখে দিলেই গলে যাবে। সেই অপূর্ব স্বাদে বিভোর মন দিকবিদিক হারিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে সোজা পৌঁছে যাবে ফালুট কিংবা সান্দাকফুর চুড়োয়। আমায় গোগ্রাসে গিলতে দেখে হাসিতে ফেটে পড়লেন অমৃতা। পেট ভরে যাবে একপ্লেটেই। কিন্তু মনকে বাগে আনা বড় কঠিন। অমৃতের স্বাদ যে পেয়েছে, তাকে কি আর বশে আনা যায়?
ভুলভুলাইয়া গলি ছেড়ে বেরিয়ে আসি মাঝদুপুরে। ঠিক করেছি, হানা দেব পরের বার। পেটে উদগ্র খিদে নিয়ে। পেটখারাপ, ভূমিকম্প, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে।
সেই কতবছর আগে কোনো এক মহাপুরুষ বলেছিলেন, ‘জিভে প্রেম করে যেইজন, সেইজন... ইত্যাদি ইত্যাদি।'
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: অমৃতা মুখিয়া, টিবেটান ডিলাইট
Powered by Froala Editor