ঐতিহ্যবাহী টেস্ট পেপার, অবিভক্ত বাংলার শিক্ষক-ঐক্য ও শতবর্ষের এবিটিএ

মহামারীর আবহে বেশ কিছু বদল এসেছে শিক্ষাবর্ষে। সাময়িকভাবে বদলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পাঠক্রমও। কম-বেশি বাদ পড়েছে সমস্ত বিষয়েরই একাধিক অধ্যায়। করোনার জন্য পরীক্ষা পিছিয়ে গেলেও, কিছু-কিছু ‘নিয়ম’ বোধহয় এক থাকে সব প্রজন্মের কাছেই। যেমন, প্রস্তুতির জন্য টেস্ট পেপার সমাধান করা। একটা সময় পর্যন্ত একমাত্র এবিটিএ কর্তৃক প্রকাশিত টেস্ট পেপারই ছিল শিরোধার্য। আজও তার জনপ্রিয়তা কমেনি একরত্তি। কলকাতা থেকে জেলা, মফস্বল ছাড়িয়ে গ্রামবাংলার নানা স্কুলের প্রশ্নপত্রের বিরাট কালেকশন অন্য কোনো টেস্ট পেপারে খুঁজে পাওয়াও ভার। টেস্ট পেপারের সূত্রে এবিটিএর নামের সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই পরিচিত। কিন্তু তার ১০০ বছরের ইতিহাসের কতটুকুই বা খোঁজ রাখি?

এবিটিএ কোনো প্রকাশনা সংস্থা নয়। এটি বাংলার শিক্ষকদের একটি সংগঠন। বলা ভালো, এশিয়ার প্রথম শিক্ষক সংগঠন। সেই ১৯২১ সালে পথচলা শুরু। দেশজুড়ে তখন চলছে স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াই। একদিকে গান্ধীজির নেতৃত্বে চলছে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে জলিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় নতুন করে দানা বাঁধছে বিপ্লবী আন্দোলন। এর মধ্যেই ১৯১৯ সালে ঘটে গেল মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার প্রক্রিয়া। এই দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষাক্ষেত্র। শিক্ষকরা তাঁদের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রতি সচেতন হচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। এইসব ঘটনাপ্রবাহের সূত্র ধরেই ১৯২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ২২ জন প্রধান শিক্ষককে নিয়ে পথচলা শুরু করল 'নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি'। সংগঠনের প্রথম সভাপতি হলেন ইশানচন্দ্র ঘোষ। প্রথম সম্পাদক মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত।

সেই বছরই রংপুরের গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত হয় সমিতির প্রথম সম্মেলন। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ১০০ জন শিক্ষক। আর ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তটির সভাপতিত্ব করলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রারম্ভিক ভাষণে আচার্য জোর দিয়েছিলেন শিক্ষার অধিকার এবং শিক্ষকের মর্যাদার প্রসঙ্গে।

পেশাভিত্তিক সংগঠন হওয়ায় পেশার দাবিই ছিল প্রাথমিক। কিন্তু চাকরির নিরাপত্তা বা বেতনের দাবিকে পিছনে ফেলে শিক্ষকদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাটা উঠে আসতে সময় লাগেনি। ১৯২৫ সালের মধ্যেই সদস্যদের মধ্যে একটা আদর্শবোধের প্রচার শুরু হয়ে যায়। সেইসঙ্গে এসে পড়ে একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা। সমিতির দাবি মেনেই প্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনেট তৈরি হয়। স্বাধীন ভারতবর্ষে তৈরি হয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব হবে ধর্মভিত্তিক। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় সমিতি। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমিতির লড়াইকে সেদিন সমর্থন জানান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

আরও পড়ুন
শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন দিশা দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার মালদার শিক্ষকের

দেখতে দেখতে স্বাধীনতা এসে গেল। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটল না। তবে সমিতির কাজকর্মে কিছুটা পরিবর্তন ঘটল। ১৯৫২ সালে সমিতির শিলিগুড়ি সম্মেলনে গৃহীত হল নতুন গঠনতন্ত্র। চলার পথের সেই বাঁকে সভাপতি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

আরও পড়ুন
প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষক থেকে বিশ্বব্যাঙ্কের শিক্ষা-পরামর্শদাতা, স্বপ্নের উড়ান মহারাষ্ট্রের রঞ্জিতের

১০০ বছর চলার পথে সমিতির নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন সত্যপ্রিয় রায়, অনিলা দেবীর মতো প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক শিক্ষিকারা। পাশে থেকেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, খালেদ চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো সংস্কৃতি জগতের কিংবদন্তিরাও। এই ১০০ বছরে ভারতবর্ষের মানচিত্রের উপর দিয়ে ঘটে গেছে অনেক পরিবর্তন। সেই সঙ্গে বদল এসেছে সমিতির কাজকর্মেও। রাজ্য অফিসের ঠিকানাই বদলেছে তিনবার। তবে শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমাজবোধের বিকাশে এখনও নিরলস এই সমিতি। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হয়েছে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। সমিতির বর্তমান সম্পাদক কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য জানালেন, এই প্রতিযোগিতায় প্রতি বছর ১০ লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে। আর সেখানে বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে যায় হিন্দি, উর্দু। আর তার সঙ্গে ভাওয়াইয়ার সুর। এখনও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে সমিতির উদ্যোগে চলে ছাত্র-সহায়তা শিবির।

আরও পড়ুন
কলকাতার বুকে গেরিলা গার্ডেনিং বাংলার শিক্ষকের

তবে এবিটিএ বলতে এখনও সবার আগে টেস্ট পেপারের কথাই মনে আসে। এই টেস্ট পেপারের বয়সও তো কম হল না। সেই ১৯৩৭ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে টেস্ট পেপার। এছাড়াও এক সময় প্রকাশিত হত সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যপুস্তক 'সাহিত্য চয়ন'। এছাড়াও অন্তত কুড়িটি বই এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ১০০ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয় সমিতির মুখপত্র 'শিক্ষা ও সাহিত্য'। ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে সমকালকে ধরে রাখে এইসমস্ত প্রকাশনা। আর আজকের এই অস্থির সময়ে, যখন মানুষের ভিতরকার হিংস্র জন্তুরা বেরিয়ে আসছে দাঁত নখ বের করে, তখন আবার নতুন করে নীতি ও আদর্শের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। সেই কথাই যেন ধ্বনিৎ হল কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের গলাতেও - "শিক্ষা প্রত্যেকের প্রাথমিক অধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা দায়বদ্ধ।" বলা যায়, শতবর্ষেও এবিটিএ আছে এবিটিএ-তেই...

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More