বয়স ১৩০ বছর। তার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীনতার ছাপ। তবুও মাথা উঁচু করেই এতদিন দাঁড়িয়েছিল বিহারের রাজধানী পাটনার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত খোদাবক্স গ্রন্থাগার। এককথায় প্রত্নতত্ত্বের স্বর্ণখনি বলা চলে এই লাইব্রেরিকে। তবে এবার ভাঙা হতে চলেছে এই ঐতিহাসিক ভবনটি। তাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে গড়াবে উন্নয়নের চাকা। নির্মিত হবে ফ্লাইওভার।
সাম্প্রতিক সময়ে যানজট অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাটনায়। আর তার সমাধান খুঁজতেই ২.২ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে নীতিশ কুমার প্রশাসন। তবে পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বৃদ্ধ লাইব্রেরিটি। একটি লাইব্রেরির জন্য তো আর উন্নয়ন আটকে থাকতে পারে না! সে জন্যই ভাঙা হবে এই লাইব্রেরির কার্জন রিডিং রুম। সেখানেই স্থাপিত হবে নির্মায়মান সেতুর স্তম্ভ। বেশ কয়েক মাস আগে অনুমতি শংসাপত্র চেয়ে আবেদন করেছিল সরকার। বিতর্ক যে ওঠেনি, তেমনটা নয়। তবে আপত্তির তোয়াক্কা না করেই সিদ্ধান্তে অনড় থাকল প্রশাসন।
১৮৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খান বাহাদুর খোদাবক্স। দরজা খুলে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। তবে তারও বহু বছর আগে গোড়াপত্তন এই গ্রন্থাগারের। জড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। খোদাবক্স খানের পূর্বপুরুষ হায়বতউল্লাহ ছিলেন মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অন্যতম একজন সভাকবি। শেষ প্রতাপশালী মোঘল সম্রাটের নির্দেশে তিনি রচনা করেছিলেন ঐতিহাসিক আইনগ্রন্থ ‘ফতোয়াহ-ই-আলমগিরি’।
তবে মোঘল রাজপরিবারের সঙ্গে যোগ থাকলেও, আর্থিক অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল ছিল না খোদাবক্সের। পারিবারিক প্রতিপত্তি বলতে অবশিষ্ট ছিল হাতে লেখা অসংখ্য পুঁথি, বই এবং ঐতিহাসিক সংগ্রহ। খোদাবক্স খানের বাবার দৌলতে সেই সংগ্রহের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় দেড় হাজারের কাছাকাছি। সেটা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়। এই বিপুল পরিমাণ গ্রন্থ যাতে সংরক্ষিত হয়, তার জন্যই বিশাল দালান বানিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে তার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন খোদাবক্স খানকে।
১৮৯১ সালে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার সময় সেই দেড় হাজার পুঁথির পাশাপাশি আরও হাজার চারেক হাতে লেখা গ্রন্থ সংগ্রহ করেন আইনজীবী খোদাবক্স খান। পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বহু দুষ্প্রাপ্য ছাপা গ্রন্থ, ফরাসি ও আরবি হস্তলিপি, মুদ্রা, ছবি, ঐতিহাসিক ভাস্কর্যদের জায়গা করে দেন এই গ্রন্থাগারে। যার মধ্যে অন্যতম ‘তারিখ-ই খানদান-ই তৈমুরা’, ‘দাওয়ান-ই-হাফিজ’, ‘কিতাব-আল-হাশাইস’-এর মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থের মূল অনুলিপি।
বর্তমানে সেখানে রয়েছে ২১ হাজারেরও বেশি হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। রয়েছে আরবিক, পার্সি, উর্দু, ইংরাজি, হিন্দি ভাষার সব মিলিয়ে আড়াই লক্ষাধিক বই। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, পাঞ্জাবি, জাপানি ভাষার গ্রন্থও খুঁজে পাওয়া যাবে সেই ভিড়ে।
কার্জন রিডিং রুম— সেতু নির্মাণের জন্য ভাঙা পড়া বিশাল ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। স্বয়ং লর্ড কার্জন খোদাবক্সের সংগ্রহে মুগ্ধ হয়েই আর্থিক অনুদান দিয়েছিলেন এই নির্মাণের জন্য। পাঠকদের নিরিবিলিতে বই পড়বার জন্য বানানো হয়েছিল সেটি।
দেড় দশক আগেই ইউনেস্কো এই লাইব্রেরিকে ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’-এর স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাছাড়া ১৯৬৯ সালের ভারত সরকার পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল এই গ্রন্থাগারকে। সেই থেকে এই গ্রন্থাগার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক। তবে তা সত্ত্বেও বিগত কয়েক বছরে অবহেলার শিকার হয়েছে খোদাবক্সের স্বপ্নের গ্রন্থশালা, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। এবার স্রেফ উন্নয়নের দোহাই দিয়েই ধ্বংস হতে চলেছে তার একাংশ।
নীতিশ কুমার প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত ঘিরেই ইতিমধ্যে উত্তপ্ত বিহারের রাজনৈতিক মহল। সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেছেন ঐতিহাসিক থেকে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরাও। অন্যদিকে এই ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আদালতে মামলা করার কথা জানিয়েছে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট এন্ড কালচার’। তবে এতকিছুর পরও খুব একটা হেলদোল নেই রাজ্য সরকারের। এক ইতিহাস মুছে ফেলে নতুন ইতিহাস তৈরির বিষাক্ত নেশাতেই যেন ডুবে রয়েছেন বিহার-শাসক…
Powered by Froala Editor