ছোটোবেলায় ইতিহাসের বইতে একটা ছবি বারবার আমাদের নজরে আসত। একজন রাজার মূর্তি; রাজকীয় পোশাক, জুতো সবই পরা। কিন্তু মাথাটি নেই! হ্যাঁ, রাজা কণিষ্ক। তাঁর স্কন্ধকাটা মূর্তিটা নিয়ে আমাদের গবেষণার শেষ নেই। নিশ্চয়ই শুধু ধড়টুকু নিয়ে বেঁচে ছিলেন না তিনি। তবে জানেনই তো, কত কী যে ঘটে যাহা তাহা। মাথা ছাড়াও যে দেহ বাঁচতে পারে, সেটাই বা কে জানত! না, পাগলের প্রলাপ নয়। অন্তত ‘মাইক’-এর কথা জানলে কখনই মনে হবে না। হ্যাঁ, মাইক; ইতিহাসের মাথাহীন মুরগি!
মাথা নেই, কিন্তু বহাল তবিয়তে চারিদিকে ঘুরছে একটা মুরগি! ভূত নয় তো? একেবারেই তা নয়। মাইকের গল্পের পরতে পরতে জুড়ে আছে এক অদ্ভুত পরশ। ঘটনাটা শুরু হোক ১৯৪৫ সাল থেকে। এপ্রিল মাসে জন্মানো একটা ছোট্ট ছানা থেকে বড়োসড়ো নধর মুরগি হয়ে উঠেছে মাইক। আমেরিকার কলোরাডো প্রদেশের একটি খামারে বসবাস তার। ১৯৪৫-রই সেপ্টেম্বর মাসে ওই খামারের মাইক এবং কৃষক লয়েড ওলসেনের ইচ্ছে হল একটু ভালোমন্দ খাওয়ার। কী খাওয়া যায়? খামারেই তো ঘোরাফেরা করছে মুরগির দল। সেখান থেকেই একটিকে ধরে এনে রান্না করে খাওয়া যায়।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। লয়েডের স্ত্রী চলে গেলেন নিজেদের খামারে। এবং এমনই কপাল, তাঁর হাতে এসে পড়ল মাইক। রান্না করার জন্য তো মুরগিটিকে মারতে হবে, এবং তার জন্য ধড় থেকে মাথাটি আলাদা করে ফেলতে হবে। একটা ছুরি বার করে মাথাটা কাটাও হল। এবং তারপরই, মিরাকল!
সবাই ভেবেছিল, মুরগিটি মরে গেছে। কিন্তু এ কি! এ যে একটু পরেই নড়েচড়ে উঠল! এ যে মরেনি! ভূত নাকি? ঘাবড়ে গেলেন লয়েড। স্বাভাবিকভাবেই ধাতস্থ হতে সময় লাগল। তারপরেও দেখলেন, ঘরের মধ্যে দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে মাইক। কাটা মাথাটি পড়ে আছে পাশেই। এ যে অদ্ভুত ঘটনা! সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল লয়েডের। মুরগিটিকে মারা ঠিক হবে না। বরং এটিই হোক তাঁদের বেঁচে থাকার অবলম্বন…
আরও পড়ুন
পৃথিবীর ‘একমাত্র’ বাদ্যযন্ত্রী পাখি, বসবাস ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে
বিশ্বের সামনে এমন মাথাকাটা জীবিত মুরগির খবর সামনে আসতেই চোখ কপালে উঠল। নিশ্চয়ই ঠকাচ্ছে মুরগির মালিক। শেষমেশ মাইককে নিয়েই বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে লাগলেন লয়েড। এ কি! এ যে সত্যি ঘটনা! মাথা তো সত্যিই কাটা। ব্যস, আর পায় কে! গোটা পৃথিবীতে নাম ছড়িয়ে পড়ল মাইকের। সবাই দেখতে চাইছে তাকে। এবং তার দৌলতে বেশ মোটা টাকাও রোজগার করতে লাগল ওলসেনরা। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ছবিও বার হল মাইকের। সে তখন সেলেব্রিটি!
কিন্তু সত্যিটা কী? মাথা ছাড়া কেমনভাবে বেঁচেছিল মাইক? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত কিছু তথ্য সামনে আনলেন। মাইকের মাথাটি যখন কাটা হয়েছিল, তখন ঠিকভাবে আঘাত করা হয়নি। ফলে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও, মস্তিস্কের প্রায় পুরোটাই অক্ষত থাকে। সেইসঙ্গে অক্ষত থাকে জুগলার শিরাও; যা মস্তিস্কে রক্ত চলাচলের অন্যতম প্রধান রাস্তা। সেইসঙ্গে একটি কানও বেঁচে যায়। হৃদপিণ্ডের কোনো ক্ষতি হয়নি, মস্তিস্কও টিকে আছে; থাকার মধ্যে নেই চোখ, নাক আর ঠোঁট। কাজেই এসবের জন্য বেঁচে যায় মাইক। খাওয়ানোর হলে ছোট্ট ড্রপারে করে দুধ আর জল ঢালা হত গলায়। ভুট্টার দানাও একটু একটু করে খেতে শুরু করল। এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যথেষ্ট সুস্থ সবল ছিল মাইক। দুই বছর পর, ১৯৪৭ সালে মারাও গিয়েছিল সে। কিন্তু ততদিনে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে মাইক দ্য হেডলেস চিকেন। এমনকি, তার জন্য কলোরাডোতে প্রতি মে মাসে বিশেষ ‘হেডলেস চিকেন ডে’-ও পালিত হয়! হাজার হোক, এমন দৃষ্টান্ত আর কটাই বা আছে!
আরও পড়ুন
মুরগির মতো ছোট্ট ডাইনোসর, ছিল কেশর এবং পশমও! চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন বিজ্ঞানীরা
Powered by Froala Editor