একদিকে একদিকে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র, অন্যদিকে নেমে এসেছে সবুজে ঢাকা পাহাড়। সূর্যাস্তের গাঢ় লাল আলো সমুদ্র ছুঁয়ে এলিয়ে পড়বে রাস্তার মসৃণতায়। ইচ্ছে করতেও পারে দাঁড়াতে। কিন্তু না থাক, একে তো বেশ সরু এই রাস্তা। এক দিক দিয়ে যেতে পারে একটি গাড়ি। আর যেতেও তো হবে বহুদূর। প্রায় ২৪৩ কিলোমিটার। মাঝে পড়বে কিছু শহর, ছোটো ছোটো গ্রাম। কোথাও বা মাথার উপর ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা ঘন অরণ্য। নেহাতই কি প্রকৃতির কোলে গড়ে তোলা এক দীর্ঘ রাস্তা? না, তার থেকে বেশি জড়িয়ে আছে ইতিহাস। যাকে বলা হয় পৃথিবীর সবথেকে দীর্ঘতম যুদ্ধস্মারক (World's largest war memorial)।
গ্রেট ওশিয়ান রোড (Great Ocean Road)—এই নামেই অস্ট্রেলিয়ার (Australia) দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে এই বিরাট রাস্তা। টরকুয়ে শহর থেকে আলানসফোর্ড পর্যন্ত তিনটি বড়ো প্রদেশের মধ্যে দিয়ে তার গন্তব্য। ১৯১৮ সালে শুরু হয়ে ১৯২২ সালে প্রাথমিকভাবে শেষ হয় এই রাস্তার কাজ। নির্মাতারা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত সৈনিক। ১৯১৫ সালে প্রায় তিন লক্ষ অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যকে পাঠানো হয় তুরস্কের গালিপোলিতে। তিন বছর ধরে যুদ্ধ করার পর পতন হয় মহাশক্তিধর অটোমান সাম্রাজ্যের। কিন্তু ততদিনে মৃত্যু হয়েছে ৬০০০০ সৈনিকের, দেড় লক্ষ সৈনিক মারাত্মকভাবে আহত অথবা অপহৃত। বাকিরা কোনোরকমে ফিরে এলেন দেশে।
না, কেউ জয়মাল্য দিয়ে বরণ করে নেয়নি তাদের। বরং চরম অর্থাভাব-দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। অনেকের জন্য চাষের জমিজমার ব্যবস্থা করা হল দেশের পশ্চিমে। তাতেও মিটল না সমস্যা। জমি উর্বর নয়, চাষের কাজেও সড়গড় নয় তারা। আর বাকি যারা রয়ে গেলেন দেশের অন্যান্য অংশে, তাদেরই বা কী গতি হবে? উপায় নিয়ে এলেন দেশের সড়কদপ্তরের প্রধান উইলিয়াম কালডার। যুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিরক্ষার উপায় তাদের কাছে নেই, কিন্তু বিজয়ীদের জন্য একটা কাজের বন্দোবস্ত তো করা যেতেই পারে। আর তার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হবে মৃত সেনাদের স্মৃতি। ইতিহাসের পাতায় থেকে বিজয়ীদের বীরগাথা। বারওন হেডসের শহরতলি থেকে অটওয় অন্তরীপকে স্পর্শ করে ওয়ারনামবুল পর্যন্ত তৈরি হবে এক রাস্তা। মাঝে সংযুক্ত করবে অসংখ্য জনবর্জিত জায়গাকে।
দেশের রাষ্ট্রপতিকে সামনে রেখে তৈরি হল গ্রেট ওশিয়ান রোড ট্রাস্ট। যার প্রধান হলেন হাওয়ার্ড হিচকক। তিনি নিজে দিলেন তিন হাজার পাউন্ড। বেসরকারি সংস্থার অনুদান আর ধারকর্য করে উঠল একাশি হাজার পাউন্ড। এত বড়ো রাস্তার জন্য কোনোভাবেই যথেষ্ট নয় এই অর্থ। ফলে ব্যবস্থা করা গেল না অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। নতুন ভবিষ্যতের আশায় বিধ্বস্ত সৈনিকদের অবশিষ্ট শক্তিটুকুই হল একমাত্র সম্বল। পাথুরে জমি, পাহাড় কেটে শুরু হল রাস্তার কাজ। ঠিক হল, রাস্তা তৈরির পর যাতায়াতকারী গাড়িদের থেকে আদায় করা ট্যাক্স থেকেই মিটিয়ে দেওয়া হবে সমস্ত দেনা। আর তারপরই তা হয়ে যাবে জনসাধারণের সম্পত্তি। প্রতি মাসে মাত্র তিন কিলোমিটার করে কাজ এগিয়ে ১৯২২ সালে সম্পূর্ণ হল রাস্তার প্রথম অংশের কাজ। সৈনিকরা ততদিন থাকতেন রাস্তার পাশেই তাঁবু টাঙিয়ে। আর পরের দশ বছরে শেষ হল বাকি রাস্তা। তার কিছুদিন আগেই মারা গেছেন হিচকক। ১৯৩২-এ উদ্বোধনের দিন তাঁর মূর্তি আর গাড়িটিকে স্থাপন করা হল বিশেষ সৌধ হিসেবে।
আরও পড়ুন
গাড়ি নেই, রাস্তা নেই: অদ্ভুত এক গ্রামের 'উপকথা'
ধারদেনা মিটতে লেগে গেল আরো চারবছর। অবশেষে ১৯৩৬-এ ভিক্টোরিয়ান স্টেট গভর্নমেন্টের মালিকানায় আসে রাস্তাটি। শুরু হওয়ার প্রায় ষোলো বছর পরে। তার কারণ, প্রথমদিকে গ্রেট ওশিয়ান রোড জনপ্রিয়তা পায়নি একেবারেই। পাহাড়ের শক্ত মাটি কিংবা মরুভূমির বালি সরিয়ে খুব বেশি প্রশস্ত করা যায়নি রাস্তাটি। ১৯৬০-এ নতুন করে সাজিয়ে তোলার পরেও অনেক জায়গাতেই রয়ে গেছে এই সমস্যা। ফলে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে যেতে হলেও উপায় থাকে না রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ার। ২০০৪-এ ধার ঘেঁষে তৈরি হয় পথচারীদের জন্য আলাদা রাস্তা।
আরও পড়ুন
টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্সের ছবিতে সাজানো রাস্তা, কোথায় রয়েছে ‘কমিক বুক রুট’?
এসবই তো আধুনিক মানুষের জন্য। আর সেই সৈনিকরা কী পেলেন? বেঁচে থাকার রসদ, নতুন কাজ আর অবশ্যই তাদেরকে কুর্নিশ জানিয়ে রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় বসানো ফলক। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, গ্রেট ওশিয়ান রোড আক্ষরিক অর্থেই ধরে রেখেছে এক ‘চলমান’ ইতিহাসকে।
Powered by Froala Editor