ঠিক এক দশক আগের ঘটনা। তামিলনাড়ু পুলিশের কাছ থেকে ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গিয়েছে জার্মানিতে। সেখানে ইন্টারপোল সংস্থার গোয়েন্দারাও প্রস্তুত। অবশেষে দুই দেশের তৎপরতায় ধরা পড়লেন সুভাষ কাপুর। ইতিমধ্যে চোলযুগের নটরাজমূর্তি চুরি নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে সারা পৃথিবীতে। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল গ্যালারি মূর্তিটি কিনেছে ৫৬ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ করে। এদিকে তামিলনাড়ুর একটি মন্দির থেকেও মূর্তি খোয়া গিয়েছে। যদিও সেটি বিক্রি করতে পারেননি সুভাষ কাপুর। তার আগেই ধরা পড়লেন ইন্টারপোলের গোয়েন্দাদের হাতে। কিন্তু সুভাষ কাপুরের তস্করবৃত্তির সবচেয়ে বড়ো শিকার যে বাংলা, সে তথ্য তখনও জানা যায়নি। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা হোমল্যান্ড সিকিওরিটি ইনভেস্টিগেসন্সের তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর সেইসব তথ্য। একুশ শতকের শুরু থেকেই একের পর এক আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালায় অসংখ্য টেরাকোটার মূর্তি বিক্রি করে এসেছেন সুভাষ কাপুর। আর এই সমস্ত মূর্তির উৎস উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপা অঞ্চলের প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র চন্দ্রকেতুগড়।
ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চার কাছে চিরকাল উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে বাংলার ইতিহাস। অথচ বঙ্গদেশে সভ্যতার ইতিহাস যে নতুন নয়, তার নানা প্রমাণ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। তেমনই একটি নিদর্শন চন্দ্রকেতুগড়। মোটামুটি ত্রয়োদশ শতককেই রাজা চন্দ্রকেতুর সময়কাল হিসাবে ধরা হয়। তাঁরই দুর্গ বর্তমানে মাটির নিচে সমাধিস্থ। তবে সেখান থেকে প্রাপ্ত নমুনাগুলির বয়স বহু প্রাচীন। মৌর্য এবং শুঙ্গযুগের একাধিক মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে চন্দ্রকেতুগড় ভগ্নস্তূপ থেকে। এই সময় পদ্মা-ভাগীরথী অববাহিকায় গঙ্গারিডি সভ্যতার কথাও শোনা যায় নানা ঐতিহাসিকের কথায়। তবে গঙ্গারিডি সভ্যতার অস্তিত্ব থাক বা না থাক, বঙ্গদেশ যে তখন থেকেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ, তাতে সন্দেহ নেই। ১৯০৬ সালে পুরাতত্ত্ব বিভাগের পূর্বাঞ্চল শাখার সুপারিন্টেনডেন্ট মিঃ লং হার্স্ট প্রথম চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নক্ষেত্র নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯০৯ সালে এসেছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সমস্ত নিয়ম মেনে খননকার্য শুরু হতে লেগে যায় দীর্ঘ ৫০ বছর। ১৯৫৬-৫৭ সালে কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামের উদ্যোগে শুরু হয় খননকার্য। একের পর এক উঠে আসতে থাকে পাল ও সেন যুগ থেকে শুরু করে গুপ্ত, কুষাণ, শুঙ্গ, মৌর্য যুগের নানা নিদর্শন। তবে ৬টি স্তর খননের পর খননকার্য থামিয়ে দেওয়া হয়।
২০০২ সালে নিউইয়র্ক শহরের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট একটি যক্ষমূর্তি কেনে সুভাষ কাপুরের থেকে। মিউজিয়ামের ক্যাটালগে মূর্তিটি শুঙ্গযুগের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মূর্তি যে পশ্চিমবঙ্গ থেকেই পাওয়া গিয়েছে, তারও উল্লেখ আছে ক্যাটালগে। কিন্তু কীভাবে এই মূর্তি আমেরিকায় পৌঁছল, তা নিয়ে কোনো তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। সন্দেহও হয়নি কারোর। ২০০৮ সালে বিষয়টি প্রথম নজরে আসে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের। তখনই সুভাষ কাপুরের নামে পুলিশে মামলা করে হয়। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু হতে লেগে যায় আরও ৩ বছর। তামিলনাড়ুর মূর্তি মামলায় সুভাষ কাপুর গ্রেপ্তার হতেই উঠে আসে পুরনো নানা তথ্য। এবং এই একটা মামলাই নয়। দেখা গিয়েছে, ততদিনে চন্দ্রকেতুগড় থেকে অন্তত ১২৬টি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা এবং অসংখ্য ছোটোবড়ো সিল ও মূর্তি পাচার করে ফেলেছেন কাপুর। তাদের মোট মূল্য ২৫ লক্ষ মার্কিন ডলারের কম নয়।
সুভাষ কাপুরের প্রতারণার শিকার ইয়েল এবং হাভার্ড ইউনিভার্সিটি। তালিকায় রয়েছে টোলেডু মিউজিয়াম, হনলুলু অ্যাকাডেমি এবং সিঙ্গাপুরের এশিয়ান সিভিলাইজেশন অ্যাকাডেমির সংগ্রহশালাও। সবচেয়ে বেশি মূর্তি তিনি পাচার করেছেন টোলেডু মিউজিয়ামে। আর যে বিষয়টি সবচেয়ে আশ্চর্য করেছিল গোয়েন্দাদের, তা হল সুভাষ কাপুরের পাচার করার পদ্ধতি। চোরাপথে নয়, বরং একেবারে সরকারি ডাক বিভাগের পার্সেলে প্যাক করে এইসমস্ত প্রত্নসামগ্রী পাঠাতেন কাপুর। ফলে তা যে আসলে বে-আইনি পথে যাচ্ছে, এমন সন্দেহ হওয়া কঠিন।
আরও পড়ুন
অবিশ্বাস্য আত্মত্যাগ, পামীর প্রত্নক্ষেত্র বাঁচাতে জঙ্গিদের হাতে খুন প্রত্নতাত্ত্বিক
সুভাষ কাপুর আজও তাঁর কাজের জন্য কারাগারে বন্দি। শিল্প-ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত প্রতারক হিসাবে তাঁর নাম চিরকাল থেকে যাবে। কিন্তু এখানেই কি সমস্ত অভিযোগের সমাপ্তি হয়ে যায়? চন্দ্রকেতুগড় আজও একইরকম পরিত্যক্ত। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সংস্থার স্মারক বোর্ডটিও মরচে ধরে পড়ে আছে। স্থানীয় মানুষরাও জানেন না এইসব ঐতিহাসিক নমুনা কীভাবে রক্ষা করা সম্ভব। সরকারি সংস্থাগুলি উদ্যোগী না হলে এমনই বহু প্রতারক হয়তো ভবিষ্যতেও হানা দেবে। এভাবেই ক্রমশ নিঃস্ব হতে থাকবে বাংলার ইতিহাস।
আরও পড়ুন
ধ্বংস হতে পারে ৮ লক্ষ প্রত্নসামগ্রী, তালিবান-হানার আশঙ্কায় কাবুল মিউজিয়াম
তথ্যসূত্রঃ
১. The Great Loot Of Chandraketugarh Artefacts, S Vijay Kumar, Swarajy Magazine
২. Subhash Kapoor: A Decade in Review, Center for Art Law
৩. চন্দ্রকেতুগড় : ইতিহাস ও সন্দেহ, তন্ময় ভট্টাচার্য, মাস্তুল পত্রিকা, ২০১৭
আরও পড়ুন
ঠুড়গা পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পে ধ্বংস হবে প্রস্তরযুগের প্রত্নক্ষেত্রও, সরব পরিবেশকর্মীরা
Powered by Froala Editor