শেষ শো দেখিয়েছে এবছরই ফেব্রুয়ারি মাসে। বয়স শতাব্দী পার করেও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল ভারতের সবচেয়ে পুরনো এই ‘গ্রেট বোম্বে সার্কাস’ নামের সার্কাস দলটি। আজকের অনলাইন স্মার্টফোন, মিডিয়া কিংবা কেবল টিভির যুগে সার্কাসের অবস্থান যে কোথায় কিয়ে দাঁড়াতে পারে তা আমরা সবাই সহজেই আন্দাজ করতে পারি। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া এই কোভিড পরিস্থিতি। রুজি রুটি জোগাড় করতে যেখানে মানুষের নাজেহাল অবস্থা, সেখানে সার্কাসের বিনোদনের চাহিদা একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই দল বাঁচাতে শেষ হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়াই। গত ১২ মে ‘সেভ গ্রেট বোম্বে সার্কাস’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলে এই সার্কাস দলটি। পেজটির বিষয়বস্তু এটুকুই, যাতে মানুষের স্বতস্ফূর্ত সাহায্যের হাত এই করোনা পরিস্থিতিতে পাশে দাঁড়াতে পারে সার্কাস দলটির। রক্ষা করতে পারে প্রাচীন এই ঐতিহ্য।
একসময় শীতকাল মানেই ছিল বড়ো কোনো মাঠে তাঁবু খাটিয়ে মাসখানেকের আস্তানা। সময় ফুরোলে আবার অন্য কোথাও। এভাবেই ঘুরে ঘুরে খেলা দেখানো, এটাই ছিল সার্কাসের পরিচিত অভ্যেস। সার্কাস যেন আমাদের ছেলেবেলার কার্টুন চ্যানেলের এক বাস্তব রূপ। না শুধু ছোটরা এর দর্শক এমনটা একেবারেই নয়। সার্কাস নিজের দক্ষতায় সব বয়সেরই বন্ধু হতে পেরেছিল। কখনো দড়ি বেয়ে একের পর এক উঠে যাচ্ছে কিছু ছেলে-মেয়ে, ব্যালেন্সের এক অসাধারণ দৃশ্য। কখনো বা একধিক গোল রিং কিংবা বোতল নিয়ে অনায়াসে জাগলিং করে চলেছে কেউ। আবার কখনো প্রভুভক্ত কুকুর প্রভুর হাতের নিশানায় খেলা দেখাচ্ছে কিংবা হাতি নির্ভুল অঙ্ক কষছে। আর এই সবকিছুর মধ্যে আসল মশলা ছিল জোকারের অনবরত নানারকমের কার্যকলাপ। সব মিলিয়ে যেন একেবারে মনোমুগ্ধ করা এক আসর।
এই 'সার্কাস' শব্দটি এদেশের নয়। খোদ বিদেশি অর্থাৎ লাতিন শব্দ। এর প্রচলন ও শুরু হয় বিদেশেই। কিন্তু তাই বলে দেশের মাটিতে সার্কাসের জনপ্রিয়তা কোনো অংশেই কম ছিল না। বিনোদনের তালিকায় সার্কাস ছিল এক অভিনব সংযোজন। মূলতঃ বিভিন্ন পশু, পাখি এবং মানুষের একসঙ্গে নানা রকমের মজার খেলা দেখানোর মধ্য দিয়ে সার্কাসের প্রচলন শুরু হয়। সময়টা ১৯২০ সাল। ভারতীয় সার্কাসের যাত্রাপথে ‘গ্র্যান্ড বোম্বে সার্কাস’ নামে একটি সংস্থার যাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিকে মূলত পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশেই শো করে এই সার্কাস। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে এই সংস্থা আরও দুটি কোম্পানির সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘গ্রেট বোম্বে সার্কাস’ নাম নিয়ে দেশের একাধিক জায়গায় খেলা দেখতে থাকে।
সার্কাসের মূল আকর্ষণ ছিল মানুষের অসাধারণ দক্ষতায় পশুকে বশ মানানোর প্রদর্শন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের বন্য জন্তু সংরক্ষণ সংক্রান্ত রায় অনুযায়ী সার্কাস থেকে বাদ পড়ে সেই বন্য পশুরা। যদিও হাতির খেলা তারও বেশ কিছু বছর পর পর্যন্ত প্রচলিত ছিল কিন্তু ২০১৩ সালের রায় অনুযায়ী হাতির খেলাও বন্ধ হয়ে যায়। সার্কাসের প্রচলিত আকর্ষণে সম্পূর্ণভাবে ছেদ পড়ে তখনই। যদিও তারপর থেকে প্রায় সব সার্কাস দলই নতুন নানা কিছু খেলার প্রচলন করে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করতে থাকে। নিত্য নতুন তৈরি নানা বিনোদনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে জিমন্যাস্টিক, ম্যাজিকের মত নানারকমের প্রদর্শনী চলতে থাকে সার্কাসে। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট শিশুশ্রম নিয়ে রায় বের করে। ১৮ বছরের নচে কারোর সার্কাসে খেলা দেখানো আইনত অপরাধ বলে বিবেচ্য হয়। বাদ পড়ে যায় অনেকেই।
আরও পড়ুন
গোটা শরীর ঢাকা ঘন সোনালি লোমে, সার্কাসে খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন ‘দ্য লায়ন ম্যান’
বর্তমানে এই দলের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩০০। শুধু এদেশীয় না, নেপাল চিন, ইংল্যান্ডের মতো নানা দেশের মানুষের সহাবস্থান এখানে। আর তাদের মধ্যে সবথেকে প্রবীণ সদস্য বিহারের তুলসিদাস চৌধুরী। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন বাড়ির অমতে ১৯৫৯ সালে সার্কাস দলে যোগ দেন এই সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার মানুষটি। জানা যায়, প্রতিদিনের শো বাবদ প্রায় ১৫০০ টাকার মতো আয় প্রত্যেকের। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে নানা খেলায়। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে এই প্রাচীন গ্রেট বোম্বে সার্কাস বিনোদনকে বহন করে এসেছে।
আরও পড়ুন
মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছে হাতি-বাঘ, বন্যজন্তুর ‘থ্রিডি’ হাজিরা সার্কাসে
তবে প্রিয় সার্কাস দলটির হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। তাই ফেসবুক দেখলেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষও হাত বাড়াচ্ছেন তাঁদের সাধ্যমতো। কিন্তু এসবের মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া যায়নি। সার্কাস-আমোদী মানুষ তাই যথেষ্ট ক্ষুব্ধ সরকারের এমন ব্যবহারে। কিন্তু এইসব চাপানউতোরের মধ্যেও যদি কোনোভাবে প্রাণ ফিরে পায় এই শতাব্দীপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান, তাহলে আধুনিকতার মধ্যেও যে ঐতিহ্যের বটফুল ফুটে থাকবে, সেকথা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন
‘ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম’ – পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদে সমন্বয়ের বার্তা রামবন্দনায়
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ভালো কাটুক শেষ জীবন, সার্কাস দলগুলির থেকে হাতি কিনে নিল ডেনমার্ক সরকার