রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে সংকলন; স্পনসর আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁ

সাল ১৯৩১। ভারতে তখনও ব্রিটিশদের রাজত্ব। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে চলছে দেশ; বাংলাও। তার মধ্যেই এসে গেল আরও একটা বৈশাখ। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। বয়সের ভার এসে পড়েছে বটে, কিন্তু দেখে বোঝার জো নেই। একইরকম কর্মোদ্যম তিনি, প্রাণচঞ্চল। দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় তখন যাতায়াত তাঁর; শান্তিনিকেতন নিয়েও ভাবনাচিন্তা অনেক। তবে বৈশাখ এলেই রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়ে ঘরে ঘরে। তাঁর জন্মের দিনটিকে একা তিনিই মনে রাখেননি, ২৫ বৈশাখের সঙ্গে বেড়ে উঠছে গোটা বাঙালি সমাজ।

সেই বছর, অর্থাৎ ১৯৩১-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭০তম জন্মবার্ষিকী। যেমন আয়োজন হয় প্রতিবার, তেমনই হয়ত হবে। কিন্তু পরিকল্পনা একটু অন্য ছিল। তার প্রয়াস, জাঁকজমক সমস্তটাই ছিল আলাদা। অমল হোম ঠিক করলেন, গুরুদেবের জন্মদিন উপলক্ষে এই বছর কিছু বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যাক। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। তৈরি হল রবীন্দ্রজয়ন্তী নিয়ে বিশেষ কমিটি। একে একে সেখানে যোগ দিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রশান্ত মহলানবিশ, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী প্রমুখ ব্যক্তি। কমিটির সভাপতি হলেন জগদীশচন্দ্র বসু। সব মিলিয়ে কবি’র ৭০তম জন্মদিন পালন করতে উঠেপড়ে লাগলেন সবাই।

তখনও রবীন্দ্রনাথ জীবিত, এবং বহাল তবিয়তে। বাঙালির জীবনে শ্রাবণ মাসের গুরুত্ব তখনও বর্ষাতেই থেমে আছে। ঠিক হল, গোটা বছরেই নানা সময় ‘রবীন্দ্র উৎসব’ পালিত হবে। ২৫ বৈশাখ যেমন অনুষ্ঠান হয়, রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়— সেসব তো হলই। তারপর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে পালিত হল ‘ঠাকুর সপ্তাহ’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে ও টাউনহলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। টাউনহলে প্রদর্শিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি, পাণ্ডুলিপি। সব মিলিয়ে জমজমাট আয়োজন।

এছাড়াও আরও একটি জিনিস হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে যে কমিটি তৈরি হয়েছিল, সেখানেই ঠিক হয় এই বছর ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে বই প্রকাশিত হবে। একটি বাংলায়, অন্যটি ইংরেজিতে। এর কাজও আরম্ভ হতে লাগল। রবীন্দ্রনাথ তো শুধু বাংলার নয়, তিনি গোটা ভারতের; বিশ্বেরও। নানা বরেণ্য মানুষ তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তৈরি হয়েছে নানা অবিস্মরণীয় কাহিনি। তাঁদের লেখা দিয়েই সেজে উঠবে এই বই…

সেইমতো কাজও শুরু হয়ে গেল। বইটির সম্পাদনার ভার দেওয়া হল ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ এবং ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যও বটে। গোটা স্মারক গ্রন্থটির ভরকেন্দ্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁকে নিয়েই গল্প, কাহিনি, কবিতা, ছবি নিয়ে সেজে উঠতে লাগল এটি। আর লিখলেন কারা? অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, হ্যারিয়েট মনরো, উইল ডুরান্ট, হেলেন কেলার, জওহরলাল নেহরু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়— তালিকা শেষ হওয়ার নয়। দেশ বিদেশের ২৬৭ জন বিশিষ্ট মানুষ, লেখক, শিক্ষাবিদরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছিলেন এখানে। আর বইটির স্পনসরের দায়িত্বে ছিলেন পাঁচজন— মহাত্মা গান্ধী, জগদীশচন্দ্র বসু, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁ এবং কোস্টেস পারমার!

লেখাও জোগাড় হল, সম্পাদনাও হল, বইটির তো নাম দিতে হয় একটা। সেই দায়িত্ব নিলেন রোমাঁ রোলাঁ। নাম দিলেন ‘দ্য গোল্ডেন বুক অফ টেগোর’। বইটি ছাপা হয় ইউ রায় অ্যান্ড সনস থেকে। নামটা একটু চেনা লাগছে কি? লাগারই কথা, কারণ এই কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রায়চৌধুরী পরিবার। উপেন্দ্রকিশোরের হাত ধরে যার সূচনা। যারা লিখেছিলেন, তাঁরা কোনো না কোনো সময় রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেছিলেন। না এলেও, এই ভারতীয় কবি’র কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। রহস্যকে বারবার খোঁজার চেষ্টা করেছেন; আর যত খুঁজেছেন ততই যেন একাত্ম হয়ে পড়েছেন সেসবের সঙ্গে। সেই খনি থেকেই উঠে আসে ‘দ্য গোল্ডেন বুক অফ টেগোর’।

সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সেই শান্তিনিকেতনের দিন থেকে কবি’কে দেখে আসছেন। দেখেছেন, আর বারবার বিস্মিত হয়েছেন। বইটির সম্পাদকীয় অংশের একটি জায়গায় তিনি লিখছেন, “… শান্তিনিকেতনে আমার দিনগুলি বেশ সুখেরই ছিল। আমি যেখানে থাকতাম, সেখান থেকে একটি দোতলা বাড়ি দেখা যেত। তিনি (রবীন্দ্রনাথ) তখন ওই বাড়িটিতে থাকতেন। ওই সময় এমন একটি দিনও আমার মনে পড়ে না, যেদিন কবিগুরু আমার আগে ঘুমোতে গেছেন। সকাল হলে আমি একটি শাল গায়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। যত সকালেই বেরোতাম, দেখতাম উনি ঘুম থেকে উঠে ধ্যানে বসেছেন। তবে অনেক সময়ই ধ্যানের কাজ আগেই শেষ হয়ে যেত। তখন আবার দেখতাম অন্য কাজে ব্যস্ত। দুপুরে বিশ্রামও নিতেন না। গোটা দিনের মধ্যে খাওয়া আর ঘুমে যতটা সময় ব্যয় না করলেই নয়, সেটা করতেন। বাকি সময় শুধু কাজ আর কাজ। শান্তিনিকেতনের ওই গরমেও তাঁকে কখনও পাখা হাতে দেখিনি; কাউকে বলেও দেননি একটু বাতাস করার কথা। নিজের মতো কাটাতেন; এমনকি এই বয়সে এসেও অনেক তরুণের থেকে তিনি বেশি কাজ করেন… এমন সময় আমার ওঁর লেখা একটি লাইন মনে পড়ে- ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’।…”

বইটির শুরুর দিকে নিজের অনুভূতির কথাও লিখেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা যে কত বিস্তৃত, এই কথা থেকেই সেটা বোঝা যাবে-
“ওঁর (রবীন্দ্রনাথের) কবিত্বশক্তি এবং জীবনের এমন সুন্দর পবিত্রতার জন্যই এত শ্রদ্ধা করি। শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বে এই পবিত্রতা, সত্যের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা এখানেই থেমে নেই। শান্তিনিকেতন কি আমারও আশ্রম নয়? এর জন্যই কি আমি দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে এখানে আসিনি? অন্যান্য স্মৃতি, মুহূর্তগুলো এতই শুদ্ধ, এতই পবিত্র যে ওগুলো জনসমক্ষে বলা যায় না”

বইটির লেখা, ছবি, অলংকরণ সব দিকেই নান্দনিকতার ছাপ স্পষ্ট। আপাতত আমেরিকার ওয়াশিংটন লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে সযত্নে রক্ষিত আছে। জীবিত অবস্থাতেই রবীন্দ্র উন্মাদনার একটা ঝলক অবশ্য দেখে যেতে পেরেছিলেন স্বয়ং কবি। কী ভেবেছিলেন, সেটা হয়তো প্রকাশ করা হয়নি তাঁর। তবে একটা কথা তো বলাই যায়, রোমাঁ রোলাঁ বইটির যথার্থ নাম রেখেছিলেন। গুপ্তধন ছাড়া আর কিই বা বলা যায় একে!

ঋণ— বিশ্বদীপ ঘোষ

Powered by Froala Editor

More From Author See More