টানা ৬০ ঘণ্টা মৃত্যুযন্ত্রণার পর বিদায় মেয়ের, হাসপাতালে তখনও কর্তব্যরত নার্স মা

মৃত্যু হাজির দোরগোড়ায়। কিন্তু ১৩ বছরের কিশোরীর স্বপ্নকে কি আটকাতে পারে মৃত্যুভয়? বরং তার মাথায় চলছে অন্য চিন্তা। অস্ফুটে আধোস্বর বলে উঠল, ‘আমকে যে স্কুল থেকে বরখাস্ত করে দেবে। দুদিন স্কুলে যাওয়া হল না যে। কেউ স্কুলে খবর পৌঁছে দেবে আমি আটকে পড়েছি এখানে?’ কাতর এক আর্তনাদ মিশে আছে সেই সুরে।

যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, তা ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে ঘটে যাওয়া এক প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা। অকুস্থল কলোম্বিয়ার পাহাড় লাগোয়া ছোট্ট শহর আর্মেরো। আর কিশোরীটির নাম ওমায়রা স্যাঞ্চেজ। বহুদিন ঘুমিয়ে থাকার পর সে-বছর হঠাৎই জেগে উঠেছিল নেভাডো ডেল রুইজ আগ্নেয়গিরি। উগরে দিয়েছিল পেটের মধ্যে জমিয়ে রাখা দীর্ঘদিনের জ্বলন্ত তরল। সেই তরলেই টানা ৬০ ঘণ্টা আটকে ছিল ১৩ বছরের কিশোরীটি। শেষে জীবনযুদ্ধে প্রকৃতির কাছেই হার মানে সে।

১৩ নভেম্বর ঘটেছিল ডেল রুইজের সেই বিস্ফোরণ। যদিও প্রায় দেড় মাস আগে থেকেই যেন সংকেত দিচ্ছিল পাহাড়, ঘটতে চলেছে ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় কীভাবে অগ্নুৎপাতের ফলে আক্রান্ত হল আগ্নেয়গিরি থেকে ৩০ মাইল দূরের এই শহর? সাধারণত অগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের পর এত দূরের কোনো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তবে ডেল রুইজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। অগ্নুৎপাতের ফলে পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা বরফের ৫-১০ শতাংশ গলে যায় তৎক্ষণাৎ। শতকরা এই হার সামান্য মনে হলেও, তা একটি গোটা অঞ্চলকে প্লাবিত করার জন্য যথেষ্ট। তবে শুধু প্লাবন তো নয়। ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগের জলের স্রোতের সঙ্গে উত্তপ্ত আগ্নেয় তরলও ঢেকে ফেলেছিল গোটা শহরকে।

সেই ঘন আগ্নেয় কাদা-স্রোতের সামনে বড়ো পাকা বাড়ি ছাড়া দাঁড়াতে পারেনি কিছুই। গোটা শহরটাই যেন হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী, ধ্বংসস্তূপ। আর এমন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই আটকে পড়েছিল ওমায়রা। পালাতে গিয়েও পরিত্রাণ হয়নি তার। ভারি পাথরের চাঁই আটকে গিয়েছিল কোমরে। তারপর ওই উত্তপ্ত স্রোতেই আকণ্ঠ ডুবে তিন দিন দাঁড়িয়েছিল স্যাঞ্জেজ। উদ্ধারের প্রচেষ্টা চললেও শেষ অবধি সকলকেই নিরাশ করে কলোম্বিয়ার কিশোরীটি।

গোটা শহরের মোট ৩১ হাজার বাসিন্দাদের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। যারা প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরাও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন কোনো না কোনো ভাবে।

বিস্ফোরণের দু’দিন পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছান ফরাসি চিত্রসাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক ফার্নিয়ার। তখনও ওই বিষাক্ত কাদার মধ্যে আটকে কাতরাচ্ছেন কয়েক শো মানুষ। আর বাকিরা হার মেনেছেন ততক্ষণে। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এবং পার্শ্ববর্তী শহরের মানুষেরা হাত লাগিয়েছেন উদ্ধারকার্যে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ফটো তুলতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন স্যাঞ্চেজকে। তখন তার হাতে আর কয়েক ঘণ্টা সময় দিয়ে রেখেছেন বিধাতা। তারপরেই শেষ হয়ে যাবে সব। সাংবাদিককে দেখেই স্যাঞ্চেজ বলে উঠেছিল স্কুলের কথা।

আরও পড়ুন
মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরে আসা যায়, বুঝিয়েছিলেন এই দশ ব্যক্তি

ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে তার যখন সাক্ষাৎ হয় তখন সারা শরীরে প্রায় জমাট বেঁধে গেছে আগ্নেয় কাদা। মুখও টকটকে লাল রক্ত জমে। দুটো চোখই পরিণত হয়েছে ঘন কৃষ্ণবর্ণে। স্যাঞ্চেজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার সঙ্গেই সময় কাটিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক। দু’-চার কথা বলে আশ্বস্ত করে রেখেছিলেন মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। তারপরই শেষ। চোখের সামনেই নীরবতাকে সঙ্গী করেই থেমে গেল ছোট্ট কিশোরী। 

পরবর্তীকালে ফ্র্যাঙ্কের ছবির দৌলতেই সামনে আসে এই ঘটনা। প্যারিসের বিখ্যাত মেচ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ছবিগুলি। সাহায্য হাত না বাড়িয়ে দিয়ে ছবি তোলার জন্য বৈশ্বিক দর্শকদের একাংশের সমালোচনায় বিদ্ধ হন ফ্র্যাঙ্ক। তবে ফ্র্যাঙ্ক আসলে কলোম্বিয়ার বাস্তবিক অবস্থাকেই তুলে ধরেছিলেন। ছবির মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় কলোম্বিয়া প্রশাসন। পুলিশ হোক কিংবা মিলিটারি, কোনোটারই ব্যবস্থা করেননি রাষ্ট্রপ্রধান সাধারণের উদ্ধারের জন্য। পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের থেকে সাহায্য প্রার্থনাও করেননি তিনি। তবে ফ্র্যাঙ্কের কাজ এবং স্যাঞ্চেজের মৃত্যু রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বে। যার চাপে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় কলোম্বিয়া প্রশাসন। ১৯৮৬ সালে স্যাঞ্চেজের ছবিগুলির জন্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অ্যাওয়ার্ডও পান ফ্র্যাঙ্ক। তবে সবটাই তিনি দান করে দিয়েছিলেন সাহায্যার্থে।

গল্পের শেষ এখানেই হতে পারত, তবে স্যাঞ্চেজের মৃত্যুর সঙ্গে উল্লেখ করা উচিত তাঁর মায়ের কথাও। কারণ স্যাঞ্চেজের থেকে কোনো অংশেই কম শক্ত ছিলেন না তিনিও। যখন সন্তান মৃত্যুশয্যায়, তখন নিরলসভাবেই তিনি চালিয়ে গেছেন নিজের কাজ। শহর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে একটি হাসপাতালে নার্সের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ডেল রুইজ দুর্ঘটনায় শুধু কন্যা নয়, গোটা পরিবারকেই হারিয়েছিলেন স্যাঞ্চেজের মা। শুধু প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল পুত্র সন্তান। তবে বিষক্রিয়ার ফলে বাদ গিয়েছিল তার একটি হাত। স্যাঞ্চেজের মৃত্যুর খবর যখন তাঁর কাছে পৌঁছে দেন সাংবাদিকরা, মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর চোখের জল মুছে পুনরায় ফিরে গিয়েছিলেন নিজের কাজে। সেদিন তিনি দায়িত্বে না থাকলে হয়তো আরও বাড়ত প্রাণহানির সংখ্যা। সন্তানের মৃত্যুশোকের উর্ধ্বে গিয়েও এমন দায়িত্বপালন ক’জনই বা করতে পারেন?

আরও পড়ুন
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন শ্যামল মিত্র, ভক্তদের জন্য গাইলেন বিশেষ গান

Powered by Froala Editor