বোম্বে থেকে মুম্বাই হোক কিংবা ক্যালকাটা থেকে কলকাতা। পৃথিবীর ইতিহাসে বহুবার নাম বদলেছে বিভিন্ন নগরীর। কখনো তার পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ, কখনো আবার কোনো বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বদল করা হয়েছে সেই শহরের নাম। তবে এই নাম বদলের খেলায় বলা যেতে পারে এক অনন্য রেকর্ড রয়েছে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সেন্ট পিটার্সবার্গের। ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে মোট ৩ বার বদলেছে এই শহরের নাম।
আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটি তৈরি হয়েছিল রাশিয়ার একেবারে পশ্চিম প্রান্তে। রাশিয়ার সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট বন্দর নির্মাণের জন্য জলবদ্ধ প্লাবনভূমিতে গড়ে তুলেছিলেন এই নগরী। বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত এই বন্দরের মাধ্যমেই যোগাযোগ চলত ইউরোপের সঙ্গে। নিজের নামের অনুসরণেই তিনি এই শহরের নাম করেছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গ। যদিও শহরের নাম স্থানীয় রাশিয়ান ভাষায় উচ্চারিত হত ‘সাঙ্কট পেটার্সবার্গ’ হিসাবেই।
প্রায় দু’ শতক এই নামেই পরিচিত ছিল রাশিয়ার অন্যতম বন্দর নগরী। তবে সমস্যার সূত্রপাত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। তখন রাশিয়ার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানি। সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট নিজে বড় হয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে। ফলে পিটার্সবার্গ নামটির মধ্যেও যথেষ্ট ডাচ-জার্মান প্রভাব ছিলই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই বিতর্ক শুরু হয় এই নাম নিয়ে। জার্মান জাতির প্রতি ঘৃণা থেকেই বদলে দেওয়া হয় শহরের নাম। বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ১৯১৪ সালে পিটার্সবার্গকে করে তোলা হয় ‘রাশিয়ান সাউন্ডিং’। নতুন নাম হয় ‘পেট্রোগ্রাদ’। ‘পেট্রো’ কথাটি স্থানীয় ভাষায় ‘পেটার’ উচ্চারণ থেকেই বিবর্তিত। যা পারতপক্ষে সম্রাট পিটার দ্য গ্রেটকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে ‘গ্রাদ’ শব্দটির অর্থ ‘নগরী’। যা সাফিক্স হিসাবে বিভিন্ন রাশিয়ান শহরের নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন
স্কলারশিপ নিয়ে রাশিয়ায় পাড়ি, মেদিনীপুরের এই যুবক জড়িয়ে রুশ বিপ্লবের সঙ্গেও
তবে এই নামও স্থায়ী হয়নি খুব বেশিদিন। মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই বদলে যায় শহরের নাম। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ততদিনে বদলে দিয়েছে রাশিয়ার খোলনলচে। রাজতন্ত্রের পতন হয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন রাশিয়ার। বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘জননেতা’ ভ্লাদিমির ইলাইচ লেনিনের নেতৃত্বে। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মান জানিয়েই এই শহরের নামকরণ করা হয় লেনিনগ্রাদ।
তবে ১৯২২ সালে নির্মিত ইউএসএসআর বা সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙনের ডঙ্কা বেজে উঠেছিল আশির দশক থেকেই। কমিউনিস্ট সরকারের ৭০ বছর পূর্তির ঠিক প্রাক্কালেই পতন হয় সোভিয়েতের। সোভিয়েতে অঙ্গরাজ্যগুলি ভেঙে তৈরি হয় ছোট ছোট নতুন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সেখান থেকে আবার নতুন করে নামকরণ শুরু হয় রাশিয়ার শহরগুলির। পুনর্নির্মাণ শুরু হয় রাশিয়ার বিশেষ ভবনগুলিরও। সেই সময়ই দাবি ওঠে পুনরায় লেনিনগ্রাদের নাম বদলে ফেলার।
আরও পড়ুন
বিস্তীর্ণ জায়গায় ছড়িয়ে ৬০টি ম্যামথের হাড়, রাশিয়ায় প্রাচীন মানুষের ‘কীর্তি’
তবে বিতর্ক ছিলই। জনৈক নেতার নামে তৈরি শহরের নাম বদলানোর প্রস্তাবে বেশ সরগরম হয়ে উঠেছিল লেনিনগ্রাদের পরিস্থিতি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমেই বদল হবে শহরের নাম। হয়ও তেমনটাই। ১৯৯১ সালে, সেই ভোটে সামান্যের জন্য এগিয়ে থাকে নাম বদলের প্রস্তাব। যার কারণে ফিরে আসে এই নগরীর সবথেকে পুরনো নামই। সেন্ট পিটার্সবার্গ। আজও এই নামেই পরিচিত রাশিয়ার এই শহর। তবে লেনিনপন্থী স্থানীয়দের একাংশ এখনও অনেকেই লেনিনগ্রাদ নামেই পরিচয় দেন তাঁদের শহরের। আবার শুধুমাত্র ‘পিটার’ বলেও সম্বোধন করেন অনেকে। তবে কতদিন স্থায়ী হবে এই নাম, তার নিশ্চয়তা নেই কোনো। কারণ, ইতিহাস জানায় জায়গার নাম বদলের নিরিখে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত দেশের থেকে এগিয়ে রয়েছে রাশিয়াই...
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
রুশ বিপ্লবের পর ঠাঁই কলকাতায়, শীতের বো ব্যারাক ও একটি রাশিয়ান পরিবারের গল্প