মৃত ব্যক্তির সঙ্গেই বিবাহ— কোথায় প্রচলিত এমন রীতি?

ভালোবাসার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত— এমনটা শোনা যায় অনেকের মুখেই। কেউ কেউ চিরকাল ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরেই থেকে যান আজীবন। কিন্তু প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধার আগেই যদি ঘনিয়ে আসে মৃত্যুর ছায়া? অধরা থেকে যায় সংসারযাপনের স্বপ্ন? মৃত প্রিয়জনের স্মৃতি আঁকড়ে আজীবন বেঁচে থাকা, সহজ নয় মোটেই। তবে তার ব্যতিক্রমও রয়েছে এই ভূ-জগতেই। এমনকি জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর পরে, মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আইনিভাবে বিবাহও করেন বহু মানুষ। 

ভাবছেন এ আবার হয় নাকি? যে-মানুষটির কোনো অস্তিত্বই নেই নশ্বর পৃথিবীতে, তাঁর সঙ্গে আইনি বিবাহ আবার সম্ভব কীভাবে? হ্যাঁ, বাস্তবেই ঘটে এমন ঘটনা। ইউরোপের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ ফ্রান্সেই (France) প্রচলিত রয়েছে এমন রীতি। ফরাসি সিভিল কোডের ১৭১তম ধারা অনুযায়ী, কেউ স্বেচ্ছায় বিবাহ করতে পারেন কোনো মৃতব্যক্তিকে। এ-ধরনের মরণোত্তর বিবাহ পরিচিত ‘নেক্রোগ্যামি’ (Necrogamy) নামে। কিন্তু হঠাৎ এমন আইন তৈরি হল কেন? 

এই আইনের নেপথ্যে রয়েছে এক মর্মস্পর্শী ঘটনা। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ১৯৫৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। বেশ কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে উপচে উঠেছে রেইরান নদী। সেই জলের চাপ সহ্য করতে না-পেরে ভেঙে পড়ে ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন রিভিয়েরা প্রদেশে অবস্থিত ম্যাপলাসেট বাঁধ। প্রাথমিক বিস্ফোরণেই মারা গিয়েছিলেন কর্মরত বেশ কয়েকজন কর্মী। পাশাপাশি বাঁধ ভাঙার ফলে, বন্যায় ভেসে যায় ১৩৫০ হেক্টর অঞ্চল। ধ্বসে পড়ে প্রায় দুশোটি বাড়ি। সবমিলিয়ে প্রাণ হারান ১৩৫টি শিশু-সহ ৪২৩ জন। যাঁদের মধ্যে অনেকের দেহই খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনোদিন। 

এই দুর্ঘটনায় নিহতের তালিকায় ছিলেন আন্দ্রা কাপ্রা নামের এক ব্যক্তিও। পাশ্চাত্য রীতি অনুযায়ী প্রেমিকার সঙ্গে ‘এনগেজমেন্ট’ হয়ে গিয়েছিল কাপ্রার। এমনকি কয়েকদিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল বিবাহ অনুষ্ঠানের। তবে দুর্ঘটনায় অপূর্ণ থেকে যায় সেই পূর্বপরিকল্পনা। তবে প্রেমিকের মৃত্যুর পরও, তাঁকে বিয়ে করার জন্য আর্জি জানান তাঁর বাগদত্তা আইরিন ডোজার্ট। প্রথম স্থানীয় আদালতের থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে, সরাসরি ফরাসি রাষ্ট্রপতির কাছে দ্বারস্থ হন তিনি। সে-সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল গোটা দেশের মিডিয়া। তাঁর আবেদনকে সমর্থন জানান সাধারণ মানুষও। ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত নতুন আইন তৈরি করতে বাধ্য হয় ফরাসি প্রশাসন। পাশ হয় মরণোত্তর বিবাহের আইন। 

অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এই আইন তৈরির নেপথ্যে আইরিন দায়ী হলেও, ফ্রান্সে মরণোত্তর বিবাহের রীতি বহু প্রাচীন। বলতে গেলে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নেপোলিয়ন কোডের আমল থেকেই চলে আসছে এই প্রথা। আসলে, সে-সময় যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ হারাতেন বহু তরুণ। এদিকে বাগদান হয়ে গেছে তার আগেই। এমন ক্ষেত্রে মৃত জীবনসঙ্গীর সঙ্গে মরণোত্তর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন বহু মহিলা। তাছাড়া দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ফ্রান্সে ব্যাপকভাবে দেখা যায় মরণোত্তর বিবাহের ঘটনা। সন্তানসম্ভবার জীবনসঙ্গী বিবাহের আগেই যুদ্ধে মারা গেলে, তাঁদের বিবাহ দেওয়া হত মৃত ব্যক্তির সঙ্গে। সন্তানের পিতৃপরিচয় নিশ্চিত করতেই প্রচলিত ছিল এই রীতি। অবশ্য খাতায় কলমে দেখানো হত কোনো বিবাহের সার্টিফিকেট পেতেন না তাঁরা। 

১৯৫৯ সালে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই রীতিকেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ফরাসি সরকার। অবশ্য কেউ হঠাৎ করে চাইলেই বিয়ে করতে পারেন না যে-কোনো মৃত ব্যক্তিকে। তার জন্য জমা দিতে হয় বিশেষ আবেদনপত্র। অনুমতি নিতে হয় মৃত ব্যক্তির পরিবারের থেকেও। পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির সঙ্গে পূর্ব-সম্পর্কের প্রমাণও দিতে হয় প্রসিকিউটারকে। সেই প্রমাণের ভিত্তিতে প্রসিকিউটর আবেদনপত্র অনুমোদন করলে তবেই আইনিভাবে বিবাহ করার অনুমতি পান জীবিত ব্যক্তিরা।

এ-ধরনের বিবাহে আইনতভাবে মৃত স্বামী বা স্ত্রীর বিষয়-সম্পত্তির ভাগ পান না মরণোত্তর জীবনসঙ্গী। শুধু ভালোবাসার মানুষটিকে আঁকড়ে থাকার জন্যই, মৃত ব্যক্তির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বহু মানুষ। আজও প্রতিবছর ফরাসি প্রশাসনের কাছে জমা পড়ে অন্তত ৪০-৫০টি মরণোত্তর বিবাহের আবেদনপত্র। যার মধ্যে ২৫ শতাংশ আবেদন খারিজ হয় ঠিকই, তবে অধিকাংশক্ষেত্রে জিতে যায় ভালোবাসাই। সত্যি হয়ে থেকে যায় সুমনের লেখা ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’-ই লাইনটুকুই…

Powered by Froala Editor