১৯৪০ সালের জুন মাস। আজ থেকে ঠিক ৮০ বছর আগের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাকমুহূর্ত। নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি মিত্রশক্তি। এর মধ্যেই ফ্রান্সের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে জার্মান সেনা। কিন্তু এই যুদ্ধ তো শুধু সামরিক পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জার্মান বাহিনীর হাতে একের পর এক মানুষ প্রাণ হারাতে শুরু করল। ফ্রান্সের বুকেও শুরু হল ইহুদি-নিধন যজ্ঞ। ঘরে ঘরে চলল তল্লাসি। সমস্ত ইহুদিদের ধরে নিয়ে যাওয়া হল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। কেউ কেউ কোনোক্রমে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও পোকামাকড় বা হিংস্র জন্তুর আক্রমণ লেগেই ছিল।
ঠিক এই সময়েই তাউলাউসের একটি কনভেন্টে বসে পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছিলেন সন্ন্যাসিনী ওরফে নান সিস্টার ডেনিস বার্গন। কনভেন্টের মধ্যেই আছে একটি বোর্ডিং হাউস। সেখানে ক্যাথলিক শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তও আছে। অনায়াসে বেশ কিছু ইহুদি শিশুকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে জার্মান বাহিনী তল্লাসির জন্য এলে তাদের ক্যাথলিক বলেই পরিচয় দিতে হবে। একটি ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়ে এই মিথ্যাচার কি অধর্ম হবে? চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন সিস্টার ডেনিস। তখন আর্কবিশপ জুল সেলেজের কাছে পরামর্শ চাইলেন তিনি। উত্তরে আর্কবিশপ লিখলেন, “মিথ্যে বলো, মিথ্যে বলো কন্যা। মানুষকে প্রাণে বাঁচানোর পুণ্যে সমস্ত পাপ ধুয়ে যাবে।” চিঠির এই দুটি বাক্য সিস্টার ডেনিসের সমস্ত সংশয় মুছে দিল।
হন্যে হয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ইহুদি শিশুদের সংগ্রহ করতে শুরু করলেন সিস্টার ডেনিস। কাউকে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন অবস্থায়। কারোর আবার পরিবারের সবাই জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও নিজেদের বাড়ির কোনো জায়গায় লুকিয়ে ছিল কেউ। একে একে মোট ৮৩ জন ইহুদি শিশুকে এনে জড়ো করলেন সিস্টার ডেনিস। তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হল। অনেকের সঙ্গে আবার কিছু পারিবারিক সম্পত্তি ছিল। সেইসব লুকিয়ে রাখা হল কনভেন্টের একটি গোপন জায়গায়। কিন্তু এর পরেও বেশিদিন জার্মান বাহিনীর চোখে ধুলো দিতে পারলেন না তিনি। ১৯৪৪ সালে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা দলের এক সদস্য এসে খবর দিলেন, জার্মান বাহিনী জানতে পেরে গিয়েছেন সিস্টারের গোপন কাজকর্ম।
তখনই বসে সমস্ত পরিকল্পনা হয়ে গেল। সেই আগন্তুক ব্যক্তি কথা দিলেন গোপনে কনভেন্টের উপর নজর রাখবেন। জার্মান বাহিনী এসে পড়লেই তিনি বন্দুকের গুলি ছুঁড়বেন। আর তখনই সমস্ত ইহুদি শিশুদের পাশের জঙ্গলে সরিয়ে ফেলা হবে। তবে কিছুদিন পর থেকেই অধৈর্য হয়ে উঠতে থাকলেন সিস্টার ডেনিস। কারণ প্রতিরক্ষা দলের সদস্যদেরও নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করেছে গেস্টাপো। তাই শিশুদের বেশিরভাগ সময়েই লুকিয়ে রাখা হত মাটির নিচে। অমানবিক সেই অবস্থাতেও তাঁদের প্রাণ তো নিরাপদ ছিল।
অবশ্য এই পরিস্থিতি বেশিদিন চলল না। ১৯৪৪ সালের শেষ দিকেই একে একে জার্মান অধ্যুষিত ফ্রান্স দখল করতে শুরু করে ফরাসি বাহিনী। তাউলাউস এলাকাও স্বাধীনতার স্বাদ পেল। কনভেন্ট থেকে বেরিয়ে এল ৮৩ জন ইহুদি শিশু। তাদের কেউ কেউ ততদিনে পরিবারের বাকিদের হারিয়েছে। সিস্টার ডেনিস না থাকলে তাদেরও হয়তো প্রাণ সুরক্ষিত থাকত না। তবে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে এভাবে এগিয়ে এসেছিলেন অনেকেই। বিভীষিকার মাঝেও এমন মানবিক দৃশ্যই মানুষের সভ্যতার উপরে আস্থা রাখতে শেখায়।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ইহুদি-নিধন তরান্বিত করছিল মহামারী, থামালেন নাৎসি ক্যাম্পে বন্দি চিকিৎসকরাই