বিশ্বের কোন প্রান্তে কোন ঘটনা ঘটে চলেছে, কোথায় বিঘ্নিত হচ্ছে জনগণের অধিকার, বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সমীকরণ এগোচ্ছে কোন পথে— এককথায় বলতে গেলে চলমান পৃথিবীর খবর মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় সংবাদপত্র। একটা সময় মূলত বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল সংবাদপত্রের পথচলা। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটালের যুগে দাঁড়িয়ে বিশ্বের খবর মুহূর্তের মধ্যে মানুষের হাতে এসে পৌঁছালেও, ছাপা খবর কাগজের জনপ্রিয়তা বা গৌরব ম্লান হয়নি কোনোটাই। কিন্তু কোনো সংবাদপত্র যদি ৪ বছর অন্তর অন্তর প্রকাশিত হয়? তাহলে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আদৌ কি কোনো গুরুত্ব থাকে তার?
এ-কথা শুনে ভ্রূ-কুঞ্চিত হওয়াই স্বাভাবিক। এ-আবার হতে পারে নাকি? সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক সংবাদপত্রের যুগ পেরিয়েছে বহুদিন হল। বর্তমানে সাপ্তাহিক, মাসিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হলেও, সেগুলি মূলত বিনোদনকেন্দ্রিক। গল্প, উপন্যাস ও কিছু কিছু বিষয়ে বিশেষ প্রবন্ধই শুধু ছাপা হয় সেখানে। দৈনিক সংবাদ সেখানে থাকে না বললেই চলে। তবে এই তালিকাতেই এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম ‘লা বুগি ডু সাপার’।
ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত এই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় কেবলমাত্র ২৯ ফেব্রুয়ারি। ফলে, বলার অপেক্ষা থাকে না, কেবলমাত্র লিপ ডে বা লিপ ইয়ারেই প্রকাশ পায় এই সংবাদপত্রের সংখ্যা। ১৯৮০ সালে প্যারিস থেকে সর্বপ্রথম প্রকাশ পেয়েছিল এই সংবাদপত্র। তারপর কেটে গেছে ৪৩ বছর। তবে এখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র ১১টি সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে এই বিশেষ সংবাদপত্রটির। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, কেন চার বছর ছাড়া প্রকাশিত হয় এই সংবাদপত্র? কী-ধরনের সংবাদই বা প্রকাশিত হয় সেখানে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে সাড়ে চার দশক। সত্তরের দশকের শেষদিক। ফ্রান্সের দুই বন্ধু— পলিটেকনিশিয়ান জ্যাক ডি বুইসন এবং পুরনো সংবাদপত্র সংগ্রাহক ও প্রেস বিশেষজ্ঞ ক্রিশ্চিয়ান বেলির হাত ধরে শুরু হয় ‘লা বুগি ডু সাপার’-এর পথচলা। কথাটির ইংরাজি অর্থ ‘দ্য সাপারস ক্যান্ডেল’। উনিশ শতকের ফরাসি কার্টুনিস্ট সাপার বা স্যাপার ক্যামেম্বারের নামানুসারেই নামকরণ এই বিশেষ পত্রিকাটির। উনিশ শতকে রাষ্ট্রতন্ত্রের অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে কার্টুনকেই হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন তিনি।
অবশ্য শুধু পত্রিকার নামকরণেই নয়, চার বছর অন্তর অন্তর এই পত্রিকা প্রকাশের নেপথ্য-কারণও তিনিই। আসলে ২৯ ফেব্রুয়ারি ক্যামেম্বার জন্মদিন। জীবদ্দশায় দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন স্যাপার। ফলে, চার বছর ছাড়াছাড়াই নিজের জন্মদিন পালন করতেন তিনি। সেই রীতি মেনেই ২৯ সেপ্টেম্বর পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন জ্যাক ডি বুইসন এবং ক্রিশ্চিয়ান বেলি।
স্যাপারের কার্টুনের ভঙ্গিতেই ব্যঙ্গাত্মক, শ্লেষাত্মক এবং কৌতুকই মূল হাতিয়ার ২০ পৃষ্ঠার এই ফরাসি সংবাদপত্রটির। প্রধানত বিভিন্ন দেশের রাজনীতির খবর, অর্থনৈতিক অবস্থা, জাতীয় প্রকল্প এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদি বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয় সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রে। সাধারণত সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক পত্রিকা বিনোদনভিত্তিক হলেও ফরাসি সংবাদপত্রটিতে বিনোদনজগৎ বা খেলাধুলোর খবর থাকে না বললেই চলে। বর্তমান সম্পাদক ভিসকাউন্ট জিন ডি’ইন্ডির কথায়, ‘মূলত এই পত্রিকা সেইসব ঘটনায় তুলে ধরে, যা বৃহত্তরভাবে জনগণের স্মৃতিতে ও জীবনে স্পষ্ট ছাপ রেখে যায়।’ তাঁর কথায়, মানবিকতা, সামাজিক নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকারের ওপর বিষেষভাবে জোর দেয় ‘দ্য সাপারস ক্যান্ডেল’। অবশ্য সার্বিকভাবে দেখতে গেলে এই পত্রিকায় খোরাকের অভাব থাকে না মোটেই।
মজার বিষয় হল, ৪ বছর অন্তর এই পত্রিকা প্রকাশ পেলেও আইরনিকভাবে 'লাস্ট মিনিট' নামের একটি বিভাগও প্রকাশিত হয় প্রতিবছর। সংবাদপত্রের পর্যায়ক্রমিতা নিয়ে বিদ্রুপাত্মক বর্ণনা প্রকাশিত হয় এই বিশেষ বিভাগে। পাশাপাশি প্রথাগত সংবাদমাধ্যম একই সংবাদ ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে কেবলমাত্র জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য। ব্যাঙ্গের মাধ্যমে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানায় 'লাস্ট মিনিট'।
বিশ্বের সবচেয়ে 'অধারাবাহিক' পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা কম নয় মোটেই। প্রতি বছরই উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে এই পত্রিকার গ্রাহকের সংখ্যা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে শুধুমাত্র ফ্রান্সেই বিক্রি হয়েছিল ২ লক্ষ কপি। পাশাপাশি বেলজিয়ামক, লুক্সেমবার্গ ও সুইজারল্যান্ড-সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিক্রি হয় লক্ষাধিক সংখ্যা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, মাত্র ২০ পাতার এই পত্রিকার দাম ৪.৮০ ইউরো। ভারতীয় মুদ্রায় যার অর্থ ৪২৪ টাকা। পাশাপাশি ১০০ ইউরো দিয়ে এক শতাব্দীর জন্য এই গ্রন্থের সাবস্ক্রিপশন নেওয়ারও সুযোগ থাকে গ্রাহকদের কাছে। ফলে লাভের অঙ্কটা কম নয় মোটেই। অবশ্য বিপুল পরিমাণ এই লভ্যাংশের সবটাই এই পত্রিকা দান করে দেয় ‘এ টায়ার ডি’আইল’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। নিখরচায় অটিস্টিক ও মৃগীরোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় এই তহবিল। সবমিলিয়ে এই পত্রিকা প্রিন্টিং দুনিয়ার এক আশ্চর্য নজির।
Powered by Froala Editor