তাঁর সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন ‘এঁর মতো আরও কয়েকজন থাকলে, ভারতের স্বাধীনতা অনেক আগেই চলে আসত।’ তিনি, পত্তি শ্রীরামুলু। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সৈনিক। এমনকি স্বাধীনতার পরেও ভারতের রাজ্যগুলির গঠনে তাঁর অবদান ও সংগ্রাম উল্লেখযোগ্য। অথচ মাত্র কয়েকটি জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে তাঁর নাম।
১৯০১ সালের ১৬ মার্চ, তৎকালীন মাদ্রাজে জন্ম নিয়েছিলেন শ্রীরামুলু। একটা সময় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যান মুম্বইতে। সেখানকার ভিক্টোরিয়া জুবিলি টেকনিকাল ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে যুক্ত হন গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলের সাথে। মাসে আয় ২৫০ টাকা। আপাতভাবে ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিল সংসার। কিন্তু, জীবন বড় নিষ্ঠুর। যখন সবকিছু ঠিকঠাক, সেইসময়ই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান শ্রীরামুলু’র স্ত্রী। কয়েকদিন পরে মারা যায় সেই সন্তানও। একেবারে অথই জলে পড়েন শ্রীরামুলু। বেঁচে থাকার যখন প্রবল চেষ্টা করছেন, তখনই শেষ সম্বল মা’ও চলে যান। ব্যস, সেখানেই সংসার ও চাকরির ইতি টানেন তিনি।
সময়টা ১৯৩০। মহাত্মা গান্ধী লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পরিকল্পনা করছেন। একে একে সাধারণ মানুষ এসে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। দেশসেবার ব্রত নিয়ে পত্তি শ্রীরামুলুও এলেন গান্ধীর সংস্পর্শে। সেই থেকে শুরু হল গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সখ্যের শুরু। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে ‘৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গান্ধীজির সঙ্গে জেলও খেটেছেন। শুধু তাই নয়, গান্ধীর সত্যের আদর্শকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ভারতের গ্রামগুলির সার্বিক উন্নতির পাশাপাশি দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও অন্যতম ভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৪৬-এর মার্চে নেল্লোরের শ্রী বেনুগোপাল স্বামী মন্দিরে দলিতদের ঢুকতে না দেওয়ার প্রতিবাদে প্রথমবার অনশন করেন তিনি। এই ইস্যুতে পরবর্তীকালে ১৯৪৯ অবধি আরও তিনবার অনশনে বসেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হন।
ভূগোল বই খুললে ভারতের যে মানচিত্র আমরা পাই, স্বাধীনতার শুরুর সময় সেটা ছিল না। ১৯৪৭-এর বেশ কিছু বছর পর রাজ্যগুলি গঠিত হতে থাকে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবি প্রথম ওঠে অন্ধ্রপ্রদেশে। তেলেগু ভাষার ওপর ভিত্তি করে এই আলাদা রাজ্য গঠনের মূল আওয়াজ ছিল শ্রীরামুলু-র। কিন্তু তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভাষার ওপর ভিত্তি করে রাজ্য গঠনের বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন না। যার ফলে শুরুর দিকে আলাদা রাজ্য তৈরির দাবিকে খুব একটা আমল দিতে চাইলেন না তিনি। এদিকে শ্রীরামুলু-সহ অন্যান্যরাও অনড়। ১৯৫১-তে স্বামী সীতারামের পর পত্তি শ্রীরামুলুও ১৯৫২ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে শুরু করেন আমৃত্যু অনশন। তাঁদের দাবি একটাই, অন্ধ্র-কে আলাদা রাজ্য করতে হবে। দীর্ঘ আটান্নদিন অনশনের পর, ’৫২-এর ১৫ ডিসেম্বর মারা যান পত্তি শ্রীরামুলু। তাঁর মৃত্যুর মাত্র চারদিন পর, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অন্ধ্র-কে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দিতে রাজি হলেন। মূলত সেই দিনটি থেকেই শুরু হয়েছিল ভারতের বর্তমান মানচিত্র তৈরির কাজ।
আরও পড়ুন
তখনও পরাধীন ভারত; ইংরেজদের হটিয়ে বাংলাতেই জন্ম নিয়েছিল দুটি ‘স্বাধীন’ সরকার
বিপ্লবী ও শহিদদের দেশ ভারত। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই হোক, বা সমাজের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে – সব জায়গাতেই তাঁরা প্রতিবাদ করে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পত্তি শ্রীরামুলু-র মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাঁদের নিজেদের ছোট বৃত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছেন। দেশের একটা বড় অংশ তাঁদের নামই মনে রাখে না। একি আমাদেরই লজ্জা নয়?
আরও পড়ুন
দিনটি 'অশুভ’ – জানিয়েছিলেন জ্যোতিষীরা; কার জেদে বেছে নেওয়া হল ১৫ আগস্টকেই?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দেশভাগ ও বাংলা সাময়িকপত্রের বিজ্ঞাপন