পার্কস্ট্রিট (Park Street) ধরে সোজা এগোলে, সে-রাস্তা মল্লিকবাজার ক্রসিং-এ গিয়ে মেশে। এখানে এসে হঠাৎ শহর তার চরিত্র বদল করে। পার্কস্ট্রিটের দু-ধারে নামকরা দেশি-বিদেশি হোটেল, রেস্তোরাঁ। বিদেশি ক্যাফে। বিশাল বিশাল ম্যানসনের ছায়াঘেরা রাস্তায় গায়ে রোদ লাগে না। এসব পেরিয়ে মল্লিকবাজার ক্রসিং-এ শহরের দৃশ্য বদলায়। গাড়ির হর্নের আওয়াজ বাড়ে, ফুটপাথবাসীর সংখ্যা বাড়ে। এভাবে শহর নিজের ভিতর হাজারটা মানচিত্রের জন্ম দেয়। এই গোটা অঞ্চলটির পুরোনো নাম আমাদের জানা। ব্যরিয়াল গ্রাউন্ড রোড৷ মৃতদের আবাসস্থল। রাস্তার ওপারে সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি। এপারে লোয়ার সার্কুলার কবরস্থান ও স্কটিশ সিমেট্রি। ফরাসিদের একটি গোরস্থানও এখানে আগে ছিল। এখন তার কোনো চিহ্ন নেই। স্কটিশ সিমেট্রির (Scottish Cemetery) অবস্থান খানিক অন্তরালে। পুড়ে-যাওয়া পার্ক শো হাউজের বিপরীত গলিপথ ধরে এগোতে হবে খানিকটা। তারপর বাঁ-হাতেই হলদে দেওয়ালের গায়ে লোহার গেট। দুশো বছর ধরে স্কটিশ কলকাতাবাসীর শেষ গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
'স্কটিশ'দের সঙ্গে কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি রয়েছে বেশকিছু। সম্ভবত উইলিয়াম হ্যামিলটন ছিলেন কলকাতার প্রথম স্কটিশ। এছাড়া ডান্ডির কারখানা, চা-ব্যবসায়ী ডানকান ট্রেডার্স থেকে থমাস লিপটন- প্রত্যেকেই ছিলেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। আলেকজান্ডার ডাফের অবদান কলকাতায় আজও উজ্জ্বল। রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কটিশ চার্চ কলেজ, স্কুল। স্কটিশদের সংখ্যা কলকাতায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে ১৮২০ সালে এই কবরখানা নির্মিত হয়। ১৯৫০-এর পর থেকে বেশ কিছুদিন উপেক্ষিত ছিল। সুনামি গেছে, আয়লার তাণ্ডব গেছে। তাতে আরোই লণ্ডভণ্ড হয়েছে। ইদানিং অবশ্য মেরামতির কাজ চলছে জোরকদমে, অ্যান্ড্রুজ চার্চের তত্ত্বাবধানে। অগত্যা, দুশো-বছরের পুরোনো কবর ফিরে দেখা। কে ছিলেন, কতবছর আগের, কী করতেন - খুঁজেপেতে দেখা হচ্ছে পরিচয়। কিছু বছর আগে, সম্ভবত ২০০৮-এ স্কটল্যান্ড থেকে একটি পরিবার এসেছিল। এখানে শায়িতা তাদের প্র-প্রপিতামহীকে খুঁজে গেছে তারা, পুনর্মিলন হয়েছে। কবরখানার ভিতরে প্রবেশ করলে এই নথিবদ্ধকরণের কাজ দেখতে পাওয়া যায়। তারপর শুরু হয়ে যায়, গাছগাছালির মধ্যে থেকে নামি-অনামা কবরের নিরন্তর উঁকিঝুঁকি।
আরও পড়ুন
পূর্ণতা পায়নি প্রেম, পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে খোদিত রইল এক কবির বিরহব্যথা
কলকাতার অনাথ গৃহহীন, পরিবারহীন শিশুদের নিয়ে কাজ করতেন জেন এলিয়েট নামের এক স্কটিশ মহিলা। শহরেই তাঁর মৃত্যু। ক্রিস্টিনা রজার উইগটন ম্যালেরিয়া ও কলেরা আক্রান্ত অসহায় কলকাতাবাসীকে সেবা করতেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর ছিলেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা থমাস নেলসন অ্যানাডেল। মৃত্যু হয় ১৯২৪ সালে। স্কটিশ সিমেটারির আনাচেকানাচে লুকিয়ে আছে এরকম হাজারো কবরের ভগ্নস্তূপ। প্রায় মুছে-যাওয়া নামগুলি থেকে তাদের উৎসে পৌঁছানো গেলে চোখের সামনে অন্য এক পৃথিবী খুলে যায়।
আরও পড়ুন
একই কবরে শায়িত স্বামী-স্ত্রী, ১৩৫ বছরের গোরস্থানে লুকিয়ে এমনই ইতিহাস
মেঘালয়বাসী আজও মনে রেখেছে একজন স্কটিশ সাহেবকে। থমাস জোন্স। রোমান স্ক্রিপ্টে খাসিভাষার অনুলিখন থেকে শুরু করে খাসি ভাষার বর্ণমালা নির্মাণে তাঁর অবদান অস্বীকার করা যায় না। যতদিন সে অঞ্চলে ছিলেন তিনি, খাসি ভাষা নিয়ে কাজ করে গেছেন। শোনা যায়, হেনরি ইংলিস নামে এক প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ীর কাজে বাধা দেওয়ায় মেঘালয় ছাড়তে হয় থমাস জোন্সকে। শেষে কলকাতায় বাস জীবনের শেষদিন অবধি। তাঁর কবরের গায়ে খোদাই করা - ''The founding father of Khasi Alphabets and Literature." প্রতিবছর ২২ জুন মেঘালয়ে 'থমাস জোন্স ডে' পালিত হয়। ওইদিনে মেঘালয়ে প্রবেশ করেছিলেন তিনি।
স্যামুয়েল চার্টার ম্যাকফারসনের সাক্ষাৎ মেলে এখানে। আলেকজান্ডার ডাফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অনুরাগী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী ছিলেন। ভারতে বসবাসের স্মৃতি নিয়ে বই লিখেছিলেন - 'Memorials of Service in India'। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন বন্ধু ডাফকেই। ১৮৬০ সালে মাত্র ৫৪ বছরে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে, কলকাতার এই গোরস্থানেই আশ্রয় পান।
আগাছার জঙ্গল ঘেঁটে ঘেঁটে গোরস্থানের একজন কর্মীই দেখিয়ে দিচ্ছিলেন প্রাচীন এই কবরগুলিকে। বেরিয়ে আসব যখন, তিনিই বললেন, "আসল কবরটা তো দেখলেন না!"
কার সেই কবর? রেভারেন্ড লালবিহারী দে। আলেকজান্ডার ডাফের এই শিষ্যকে দিয়েই বাঙালির 'ডেঁপোমি'র আখ্যান শুরু। বাংলার উপকথার প্রথম সংগ্রাহকও তিনিই।
কবরস্থান থেকে বেরোনোর আগে আরেকবার পুরোটা দেখে নেওয়া গেল। সত্যিই কি এই কবরস্থান ঘুরে দেখা এইসময়ের মানুষকে কিছু দিতে পারে? তার কি আদৌ কোনো দরকার আছে?
দুশো বছরে শহর অনেকটা বদলে গেছে ঠিকই। শহরের মানুষ, তাদের ভাষা, পরিচয়, যাপন - সব নিয়েই অনেকটা সরে এসেছে পুরোনো থেকে। তবু, অতীত, ইতিহাসকে অস্বীকার করা চলে না। সেখানে শহরের শিকড় লুকিয়ে থাকে। পুরোনো কবরস্থানগুলি তেমনই একেকটি শিকড় অথবা দলিল। হয়তো বা পুঁথিতে লেখা ইতিহাসের থেকেও তা অনেকবেশি জীবন্ত। তাই এদের সংরক্ষণ যেমন দরকার, তেমনই দরকার শহরবাসীর যাপনের সঙ্গে তার নিয়ত যোগাযোগ। নইলে অতীত শুধুই এক মায়াময় অলৌকিক জগৎ হয়ে থাকবে। তখন নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে, তার জন্য দুঃখ করা ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকবে না।
Powered by Froala Editor