বুঝলেন, সময়টা দশম শতকের শেষভাগ। পালবংশের সিংহাসন তখন বেশ বিপর্যস্ত, সবেমাত্র রাজা হয়েছেন দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র মহীপাল। নতুন রাজা, তিনি রাজ্যের ঐশ্বর্যবৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করেছেন, ঠিক এইসময়ে দক্ষিণভারত থেকে ঘনিয়ে এল বিপদ। বাংলা আক্রমণ করলেন সে যুগের ভারতবর্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা, চোলরাজ রাজেন্দ্র (Rajendra Chola)। উড়িষ্যা থেকে শুরু করে রামেশ্বর অবধি বিস্তীর্ণ পূর্বসমুদ্রের উপকূল তখন চোলবংশের অধীনে, এমনকী তাঁর প্রচণ্ড নৌবাহিনীর পরাক্রমে সুমাত্রা, মালয় আদি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বহু দ্বীপরাষ্ট্র বশ্যতা স্বীকার করেছে, শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক আদানপ্রদান। এহেন চোলরাজ রাজেন্দ্র ছিলেন শিব-গতপ্রাণ। তাঁর খেয়াল হল, বঙ্গদেশ থেকে গঙ্গাজল এনে পবিত্র করবেন নিজের রাজ্য। ব্যাস, আর কী, চল বঙ্গবিজয় অভিযানে!
তাঁর সেনাপতি বঙ্গের সীমান্তে এসে প্রথমে পরাস্ত করলেন দণ্ডভুক্তির অধিপতি ধর্মপালকে। তারপর পরাস্ত হলেন দক্ষিণ রাঢ়ের অধিপতি রণশূর, যুদ্ধক্ষেত্রে আপন প্রাণ বাঁচাতে হাতির পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে গেলেন বঙ্গাল দেশের শাসক গোবিন্দচন্দ্র। অবশেষে, পরাভূত হলেন মহীপাল। মহীপালের দুর্মদ রণহস্তীর দল, অন্তঃপুরের সুন্দরী নারীগণ আর অজস্র ধনরত্ন পরিণত হল রাজেন্দ্র চোলের বাহিনির লুঠের মালে। উত্তর রাঢ়ভূমি অধিকার করে, অসংখ্য কুম্ভে গঙ্গাজল পূর্ণ করে দেশে ফিরে গেলেন চোলসেনাপতি। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, কেবল গঙ্গাজল আনয়নের জন্যই যদি এত যুদ্ধ, লুঠপাট, সম্ভ্রমনাশ এবং প্রাণনাশের আয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয়, ধর্মের অজুহাতে পরপীড়নের এমন নির্লজ্জ উদাহরণ সে যুগের ইতিহাসে কমই আছে!
কিন্তু, এইসব ছাড়াও শিবভক্ত রাজেন্দ্র চোলের অনুচরেরা তাঁর বঙ্গবিজয়ের আরও একটি স্মারক নিয়ে যান নিজের রাজ্যে। সেটি হল, নর্তেশ্বরের বিগ্রহ।
চিদম্বরম ক্ষেত্রের অতি নিকটে, তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর জেলার মেলক্কাডম্বুর গ্রামের অমৃতঘটেশ্বর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলেন বাংলার শিবঠাকুর। কী অপূর্ব সেই ধাতব বিগ্রহ, তা দেখলে রাজেন্দ্র চোলের শিল্প-সংগ্রাহক মনটির তারিফ না করে উপায় থাকে না! বৃষরূপী নন্দীশ্বরের পৃষ্ঠে ললিত তাণ্ডবে মত্ত নর্তকরাজ, তাঁর বাহনটি ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দেখছে সেই নৃত্যলীলা। মহেশ্বরের মাথায় জটামুকুট, স্কন্ধে নাগ-উপবীত, অঙ্গে অঙ্গে বিবিধ অলঙ্কারের সমারোহ। সম্মুখভাগে প্রসারিত তাঁর মুখ্য দক্ষিণহস্তে রয়েছে গজহস্ত মুদ্রা, বাম হাত উপরে তুলে পতাকামুদ্রায় ত্রিজগতকে অভয় দিচ্ছেন। অন্য আটটি হাতে রয়েছে ধনুর্বাণ, খড়গ-চর্ম, ত্রিশূল, খট্টাঙ্গ, কপালপাত্র আর অঙ্কুশ। তাঁর ঊর্ধ্বলিঙ্গ দশা আত্মসংযমের প্রতীক। তাঁর পায়ের কাছে, তাঁকে ঘিরে রয়েছেন গণপতি, স্কন্দ এবং অন্যান্য অদ্ভুতদর্শন শিবানুচরের দল। মহাদেবের প্রভামণ্ডলের দক্ষিণাংশে শূন্যে মরালপৃষ্ঠে বিরাজ করছেন বীণাধারিণী সরস্বতী, ঊর্ধ্বভাগে হাতে পুষ্পমালা নিয়ে ভেসে রয়েছেন দুই বিদ্যাধর। গীত, বাদ্য ও নৃত্যের ত্রিধারার সমন্বয়ে পূর্ণতা পাচ্ছে এক আশ্চর্য সঙ্গীত!
আচ্ছা, বাংলা থেকে নর্তেশ্বরের এমন অপূর্ব একটি বিগ্রহ যখন লুঠ করে আনা হয়েছিল, তখন সেখানে নিশ্চয়ই আরও অনেক এমন বিগ্রহের নির্মাণ, প্রতিষ্ঠা ও পূজার চর্চা ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই। সেই ব্যাপারেই প্রমাণ দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক নলিনীকান্ত ভট্টশালী।
ভট্টশালী মহাশয় জানিয়েছেন, দক্ষিণভারতে যেমন ‘নটরাজ’, পূর্বভারতে তেমনই ‘নর্তেশ্বর’ নামক নৃত্যরত শিবমূর্তির পূজা প্রচলিত ছিল। বিশেষত ঢাকা এবং ত্রিপুরায় এই বিগ্রহের বেশ কিছু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। ‘নাটেশ্বর’ গ্রামে (নামটি খেয়াল করার মতো) পাওয়া গিয়েছে নৃত্যরত শিবের একাধিক মূর্তি। ত্রিপুরার ‘নাটঘর’ গ্রামে এখনও নিত্যপূজিত হন নর্তেশ্বরের শ্রীবিগ্রহ।
এই মূর্তি মূলত দুইপ্রকার- দশভুজ নর্তেশ্বর এবং দ্বাদশভুজ নর্তেশ্বর। দশভুজ নর্তেশ্বরের ক্ষেত্রে মৎস্য মহাপুরাণে (অধ্যায় ২৫৯) বর্ণিত দশবাহু শিবমূর্তির বিবরণ অনুসৃত হয়েছে। এই বিবরণ অনুসারে, দশভুজ নর্তেশ্বর সূর্যসন্নিভ তপ্তকাঞ্চনবর্ণ এক ষোড়শবর্ষীয় তরুণ। তাঁর লোচন আয়ত, জটাবদ্ধ কেশ নৃত্যের তালে ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত, তাঁর স্কন্ধ, বাহু, ঊরু আদি অবয়বসংস্থান দৃঢ় ও বলিষ্ঠ। তাঁর পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম, শরীরে হার, কেয়ূর, কুণ্ডল আদি অলঙ্কার, এছাড়া শিরোদেশে জটামুকুট ও সর্বাঙ্গে নাগভূষণ তো আছেই। খেটক, খড়গ, শক্তি, দণ্ড, ত্রিশূল, কপাল, নাগ, খট্টাঙ্গ, বরমুদ্রা ও গজহস্ত মুদ্রা—এই হল তাঁর দশটি আজানুলম্বিত করপদ্মের দশবিধ আয়ুধ-সংস্থান। সৌম্যমূর্তি সুশোভন নর্তেশ্বর বৈশাখ স্থানকে নৃত্যাভিনয়ে আনন্দমগ্ন। এই পৌরাণিক বিবরণ অনুসারেই বাংলার দশবাহু নটসম্রাটের মূর্তিগুলি নির্মিত, বলেছেন ভট্টশালী মহাশয়। তবে, বাংলায় নর্তেশ্বরের দুইপাশে দণ্ডায়মানা থাকেন তাঁর দুই পত্নী- দক্ষিণভাগে মকরবাহিনী গঙ্গা, বামভাগে সিংহবাহিনী উমা। এছাড়াও, মূল দেবতার আশেপাশে আবরণ দেবতাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
দ্বাদশবাহু নর্তেশ্বরের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাহুদুটিতে তিনপ্রকার বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। কখনও তিনি দুই বাহুতে ধারণ করেন বীণা, কখনও ধারণ করেন শেষনাগকে, আবার কখনও বাহুদুটি ঊর্ধ্বে তুলে অঞ্জলিমুদ্রায় করতালি দিয়ে নৃত্যের তাল-লয়াদি রক্ষা করেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর নৃত্যের মঞ্চরূপে শিবের পদতলে উপস্থিত থাকেন রুদ্রবাহন নন্দীশ্বর। অসমতল, এবং গতিশীল এই অদ্ভুত নাটমঞ্চে যিনি আনন্দনৃত্যে মগ্ন, তিনিই তো সর্ব-নর্তক-শিরোমণি!
গৌড়ীয় ধ্রুপদী নৃত্যের পুনরুজ্জীবনের অন্যতম নেত্রী মহুয়া মুখোপাধ্যায় নর্তেশ্বরের এই রূপকল্প প্রচারে বহুদিন ধরে নিযুক্ত। তাঁর ছাত্র অনির্বাণ দেব জানালেন, দক্ষিণের নটরাজের সাথে বাংলার নর্তেশ্বরের অন্যতম বৈসাদৃশ্য এই যে, নটরাজ পদতলে বিমর্দিত করেন অপস্মার নামক অসুরকে। অর্থাৎ সেই মূর্তি অমঙ্গলকে দলিত করে বৈশ্বিক মঙ্গলপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধক্ষণকে সূচিত করে। আর বাংলার নটেশ্বর হলেন নটরাজের পরবর্তী প্রকাশ, যেখানে অসুরদমনের পালা সাঙ্গ হয়েছে। মহাদেব নাচছেন ধর্মমূর্তি নন্দীশ্বরের পৃষ্ঠে, নিত্য আনন্দের মত্ততায়। এই নৃত্যের নাম 'ললিত আনন্দ তাণ্ডব'। শিবের এই নর্তেশ্বর প্রকাশ তাই নটরাজ মূর্তিরও ঊর্ধ্বে।
কথায় কথায় উঠে এল নর্তেশ্বরের বিশেষত্ব নিয়ে আরও কিছু তথ্য। দ্বাদশভুজ নর্তেশ্বরের ঊর্ধ্বস্থিত যে দুটি হস্তে তিনি নৃত্যের তালরক্ষা করছেন, সেই ভঙ্গিমা হল মহাকাল কর্তৃক কালচক্রকে নিয়মবদ্ধ রাখার লীলার দ্যোতক। এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে পারি রবীন্দ্রনাথের গান... "দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে।" শিবের নৃত্যের ছবি রবীন্দ্রনাথের বহু রচনাতেই ফুটেছে। এই যেমন, নৃত্যকালীন ভ্রমরীর ফলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া জটাজালের ছবি পাচ্ছি তাঁর আরেকটি গানে, "প্রলয়নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে/ হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে।" আচ্ছা, কবিগুরু কি বাংলার এই বিশেষ নর্তেশ্বর বিগ্রহের ছবি কোনও কবিতায় এঁকেছেন? হ্যাঁ, অবশ্যই। তাঁর 'সুপ্রভাত' কবিতায় তো কবি স্পষ্টই আঁকছেন বীণাধর শিবের ছবি, "রুদ্রবীণায় এই কি বাজিল সুপ্রভাতের রাগিণী?" আরও প্রমাণ আছে। দক্ষিণে শিবের মুখ্য আয়ুধ ত্রিশূল, বাংলায় তা হচ্ছে খড়গ। নর্তেশ্বরের করস্থিত এই জ্ঞানরূপ খড়গ অজ্ঞানকে দ্বিখণ্ডিত করে, বিনাশ করে আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক দু:খ। এই রৌদ্রখড়গের উল্লেখ পাই 'সুপ্রভাত' কবিতাতেই...
"এতদিন পরে হঠাৎ যেন রে
অমানিশা গেল ফাটিয়া,
তোমার খড়গ আঁধার-মহিষে
দু-খানা করিল কাটিয়া।"
বিদ্বান পাঠকের মনে পড়তে বাধ্য, শ্রীশ্রীচণ্ডীতে 'কাল'-প্রদত্ত খড়গের আঘাতেই দেবী মহিষাসুরের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলেন। এই কবিতায় অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের দুটি রূপকল্প পাই, এক, অমাবস্যার অবসানলগ্ন, আর দুই, প্রভাতের সূর্যোদয়। আশ্বিনের শারদপ্রাতে, পিতৃপক্ষ নামক কৃষ্ণপক্ষের অবসানে আসে শুক্লপক্ষ, দুর্গা-আরাধনার জন্য যার খ্যাতি 'দেবীপক্ষ' নামে। আর, এই দশভুজা দুর্গার শিরোপরি চালচিত্রে যে শিবমূর্তির অধিষ্ঠান, কীমাশ্চর্যম্, তিনিও যে বাংলার ঐতিহ্যে বীণাধর শিব!
ইনিই, বাংলার শিব। ইনি গীত, বাদ্য, নৃত্যের সমন্বয়ে সদা সঙ্গীতমত্ত। ইনি নিত্য আনন্দময়। এঁর উদ্দেশেই বাংলার কবি লেখেন,
"মোর সংসারে তাণ্ডব তব কম্পিত জটাজালে।
লোকে লোকে ঘুরে এসেছি তোমার নাচের ঘূর্ণিতালে।
ওগো সন্ন্যাসী, ওগো সুন্দর, ওগো শঙ্কর, হে ভয়ঙ্কর,
যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,
জীবন-মরণ-নাচের ডমরু বাজাও জলদমন্দ্র হে॥
নমো নমো নমো -
তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম।।"
গ্রন্থপঞ্জি:
* রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১)
* রমেশচন্দ্র মজুমদার, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ (১)
* মহুয়া মুখোপাধ্যায়, 'গৌড়ীয় নৃত্য'
* মৎস্যপুরাণ
* C. Sivaramamurti, ‘Nataraja in Art, Thought and Literature’
* Nalinikanta Bhattashali, ‘Iconography of Buddhist and Hindu Sculptures in Dacca Museum’
Powered by Froala Editor