ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে যে রাস্তাটা হসপিটাল রোডের উল্টোদিক থেকে দক্ষিণে চলে গেছে, তার আশেপাশের অঞ্চল যেন ইতিহাসের খনি। পুরনো কলকাতার একটা ছোঁয়া, আমেজ ছড়িয়ে আছে এই জায়গায়। একদিকে আলিপুর চিড়িয়াখানা, বেলভেডিয়ার হাউস, আর তার পাশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেবেন্দ্র লাল খান রোড। এর ধারেই রয়েছে ভবানীপুর গোরস্থান। ভেতরে ঢুকলে সারি সারি মৃতদের সারি। সেখানেই একটি বিশেষ সমাধির দিকে চোখ পড়ল। সুন্দর, সাজানো, পরিষ্কার একটি সমাধি। আর ফলকের গায়ে খোদাই করা একজোড়া বক্সিং গ্লাভস। নিচেই লেখা— ‘ইন মেমোরি অফ পি এল রায়, দ্য ফাদার অফ ইন্ডিয়ান বক্সিং’…
বাংলার ক্রীড়া ইতিহাসে স্রেফ সৌরভ গাঙ্গুলি, দিব্যেন্দু বড়ুয়া বা ময়দানের স্বর্ণযুগের ফুটবলাররা নন। এই বিশাল আকাশের আনাচে কানাচে বেঁচে আছেন অনেক নক্ষত্র। তাঁরা নিজেরাই একেকটি অধ্যায়। পি এল রায়, অর্থাৎ পরেশলাল রায়ও সেইরকমই একজন প্রবাদপ্রতিম নক্ষত্র। আর পরিচয়? ওই যে ওপরেই লেখা হয়েছে- ভারতীয় বক্সিং জগতের জনক।
১৮৯৩ সালে বরিশালের বিখ্যাত রায় পরিবার। কর্তা প্যারীলাল রায় ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত ব্যারিস্টার। বিশাল সম্পত্তি তাঁর, রাজার হালে থাকেন। সেই ঘরেই জন্ম নিলেন পরেশলাল। পরিবারের একটা ঐতিহ্য তো শুরু থেকেই ছিল। শুধু রায় পরিবারই নয়; মা ললিতা রায় ছিলেন বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তীর (ইনি পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত ভারতের প্রথম চিকিৎসকদের মধ্যে অন্যতম) কন্যা। খ্রিস্টান আবহ এবং সেইসঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা— এই সবকিছুর হাত ধরে বড়ো হচ্ছিলেন পরেশলাল রায়।
ভারতে থেকে ভালো ইংরেজি শিক্ষা হবে না— এমনটাই ধারণা ছিল প্যারীলালের। অতএব, নিজের সন্তানদের সেই ছোটো বয়সেই পাঠিয়ে দিলেন বিলেতে। বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী পরেশলালও চলে গেলেন লন্ডন। কতই বা বয়স, দশ বছরও পূর্ণ হয়নি। সেখানেই বেড়ে উঠলেন তিনি। লন্ডনের সেন্ট পলস স্কুলে পড়াশোনা করলেন, কেমব্রিজ থেকে প্রথম এশিয় হিসেবে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকোত্তরের পড়াশোনাও শেষ করলেন। আর সেইসঙ্গে শুরু করলেন বক্সিংও…
তখন সেন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হয়েছেন সবে, দশ বছরের ছোট্ট ছেলে তিনি। এমন সময়ই আলাপ হল বিলি চাইল্ডসের সঙ্গে। বক্সার বিলি তখন বক্সিংয়ের ট্রেনিং দিচ্ছেন ছোটোদের, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হননি। তাঁর কাছেই বক্সিং শিখতে শুরু করলেন পরেশলাল রায়। অচিরেই আলাপ হল কিংবদন্তি বক্সার জিম ড্রিসকলের সঙ্গে। এরপর জিম নিজে শেখাতে লাগলেন পরেশলালকে। ধীরে ধীরে বক্সিং রিংকে ভালোবাসতে শুরু করলেন তিনি, ওই গ্লাভস জোড়া তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। স্কুলে তো চ্যাম্পিয়ন হলেনই; পরে কেমব্রিজেও বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘অক্সফোর্ড ব্লু’ খেতাব পান। এরপর ১৯১৪ সাল— ইংল্যান্ডে বান্টামওয়েট চ্যাম্পিয়ন হলেন পরেশলাল রায়। মাত্র ২১ বছরের তরতাজা যুবক তিনি। প্রথম ভারতীয় হিসেবে, বিদেশে গিয়ে বক্সিং জগতে এমন ছাপ রাখা, সে এক বিশাল ব্যাপার। বাঙালি হলেও, দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার জন্য উচ্চারণে একটু টান এসে গেছে। কিন্তু দেশের জন্য মন কেমন করার সূচনাও সেই তখন থেকেই…
১৯১৯ সাল। বিলেতের পাট চুকিয়ে বাংলার বুকে ফিরে এলেন পরেশলাল রায়। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ভাই ইন্দ্রলাল রায় সেই যুদ্ধেই বীরত্ব দেখিয়ে শহিদ হয়েছেন। বাংলায় এসে পরেশলাল যুক্ত হলেন বেঙ্গল রেলওয়েতে। কিন্তু সে তো জীবিকার প্রয়োজনের জন্য। ভেতরে তো গেঁথে আছে বক্সিং। দেশে ফিরে দেখলেন, বক্সিং নিয়ে সেরকম কোনো উন্মাদনাই নেই। যেটুকু আছে, তাও ব্রিটিশ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে। ভারতীয়দের মধ্যে এই খেলা নিয়ে কোনো উৎসাহই নেই। তাহলে?
আরও পড়ুন
ডাক পেয়েছেন রানি এলিজাবেথের থেকেও, বাঙালিই মনে রাখেনি বিজ্ঞানী মাধবচন্দ্র নাথ-কে
এখান থেকেই পরেশলাল রায়, অর্থাৎ পি এল রায়ের যাত্রাটা শুরু হল। বালিগঞ্জে নিজের বক্সিং ক্লাব তৈরি করলেন। এবং সেখানে বাঙালি তরুণদের ডেকে বক্সিং শেখাতে লাগলেন। সবটাই করলেন নিজের তাগিদে, খেলাটাকে ভালোবেসে। শুধু বক্সিং শেখানোই নয়, নিজেও রিংয়ে নেমেছিলেন বেশ কয়েকবার। সেই সময় ভারতের সেরা বান্টামওয়েট বক্সার ছিলেন এডগার ব্রাইট। ওল্ড এম্পায়ার থিয়েটারে তাঁর বিরুদ্ধেই খেললেন পরেশলাল রায়। এবং দাপটের সঙ্গে ব্রাইটকে হারালেনও। এরকম আরও প্রতিযোগিতায় নিজেই লড়তে লাগলেন। সেইসঙ্গে চলল বক্সিংয়ের প্রশিক্ষণও…
শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই থেমে থাকলেন না; তৈরি করলেন বাংলার প্রথম বক্সিং ফেডারেশন। প্রথমে প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, পরে সভাপতি হয়ে ভারতীয় বক্সিংকে আরও বৃহত্তর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে লাগলেন। পরেশলাল রায়ের হাত ধরেই একে একে সামনে আসতে লাগলেন সন্তোষ দে, ফণীন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, জনি নাটাল, আবুলাল, আর অস্টিনের মতো বক্সাররা। তাঁর হাত ধরে নতুন সূর্য দেখল ভারতীয় বক্সিং। একটা সময় যা কেবল বিদেশিদের খেলা ছিল, সেটা এখন ভারতীয়রাও শিখতে শুরু করলেন। পি এল রায় হয়ে গেলেন ‘ভারতীয় বক্সিংয়ের জন্মদাতা’…
কেউ বক্সিং শিখতে এলে, পরেশলাল রায়ের অদ্ভুত একটি নিয়ম ছিল। বক্সিং শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রথমে জিজ্ঞেস করতেন যে সত্যিই সে শিখতে চায় কিনা। সদুত্তর এলেই সজোরে এক ঘুষি! ওইরকম একটি ঘুষি খেয়েও যদি সে রাজি থাকে শেখার জন্য, তখন বুকে টেনে নিতেন পরেশলাল রায়। এমনই ছিলেন তিনি। মৃত্যুর সময়ও শেষ শয্যায় বক্সিং গ্লাভসের ফলক সঙ্গী হয়ে থেকেছে। পরেশলাল রায় এক জ্বলন্ত ইতিহাস। ভারতের ক্রীড়া জগতের এক প্রাণপুরুষ…
আরও পড়ুন
কিক বক্সিং-এ বিশ্বজয়ী, জীবনের দৌড়েও অনুপ্রেরণার পাঠ দিচ্ছেন এই বাঙালিনী
তথ্যসূত্র-
১) ‘Paresh Lal Roy – Father of Indian Boxing, was 1914 Bantamweight champion of England’, Get Bengal
২) ‘Paresh Lal Roy, the Father of Indian Boxing’, Rangan Datta
৩) ‘পিএল রায় মানেই বাঙালির ঘুসিতে সাহেব কুপোকাতের কাহিনি’, দেবযানী সরকার, কলকাতা ২৪x৭
Powered by Froala Editor