‘হাম দো, হামারে দো’ কিংবা ‘ছোটো পরিবার, সুখী পরিবার’— এইসকল শব্দবন্ধের সঙ্গে সকলেই অল্প-বিস্তর পরিচিত আমরা। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে ফ্যামিলি প্ল্যানিং অর্থাৎ পরিবার পরিকল্পনা নিয়েই। খনিজই হোক কিংবা খাদ্য— অফুরান সম্পদের ভাণ্ডার থাকে না কোনো দেশেই। তাই জনসংখ্যার আধিক্য প্রভাবিত করতে পারে দুর্ভিক্ষ কিংবা অতিদারিদ্রের মতো বিষয়। স্বাধীনতার পর থেকেই তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। গঠন করেছে বিশেষ কমিশন। চালু হয়েছে পরিবার পরিকল্পনা নীতি (Family Planning Policy)। আর এই নীতির নেপথ্যেই রয়েছে এক বিস্মৃত মহিলা আইনজীবী (Lawyer)।
আভাবাই ওয়াদিয়া (Avabai Wadia)। হ্যাঁ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবার পরিকল্পনা নীতির উপস্থাপক এবং উদ্ভাবক তিনিই। তাছাড়াও নারী ও মানবাধিকার নিয়ে সরকারের আইন তৈরির পিছনেও রয়েছে তাঁর সরব প্রতিবাদ এবং উপস্থিতি।
জীবনের অধিকাংশ সময় ভারতে কাটলেও, ১৯১৩ সালে ওয়াদিয়ার জন্ম সিলনের এক পার্সি পরিবারে। আজ যা পরিচিত শ্রীলঙ্কা নামে। সিংহলের প্রথম মহিলা হিসাবেই যুক্তরাজ্যের বার কাউন্সিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন আভাবাই। তাঁর এই সাফল্যের পরেই নারীদের আইন অধ্যয়নের স্বীকৃতি দিয়েছিল সিলোনিজ সরকার। তবে সিংহলের অতিসাধারণ মেয়ে থেকে আইনজীবী হয়ে ওঠার লড়াই সহজ ছিল না খুব একটা।
সময়টা ১৯৩০-এর দশক। দু-একটা ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা বাদ দিলে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তখনও সেভাবে পড়াশোনার অধিকার বা সুযোগ— কোনোটাই পাননি মহিলারা। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই সমাজের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন ওয়াদিয়া। তার ওপর আবার কালাপানি পেরিয়ে লন্ডনযাত্রা। সবমিলিয়ে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে খুব একটা ভালো দেখেনি সিংহলের সমাজ। যদিও পরবর্তীতে লন্ডন এবং কলম্বো উভয় জায়গাতেই আইনজীবীর কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন তিনি?
আরও পড়ুন
মহিলাকর্মীদের যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে লড়ছেন তামিলনাড়ুর সন্ন্যাসিনী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডন থেকে মুম্বাই তথা তৎকালীন বোম্বেতে চলে আসেন ওয়াদিয়া। প্রথাগত আইনজীবীর কাজ ছেড়ে হয়ে ওঠেন সমাজকর্মী। নিজের আত্মজীবনীতে ‘দ্য লাইট ইন আওয়ারস’-এ ওয়াদিয়া লিখেছিলেন, “আইনগত পেশা চালিয়ে না যাওয়াকে, আমার অপচয় মনে হয়নি কোনোদিনই। বরং, সমাজসেবীর জীবনযাপনের মধ্যেই আইনের উপাদান অনুভব করেছি বার বার।”
আরও পড়ুন
প্রথম এশীয় মহিলা হিসেবে মলোকাই চ্যানেল জয় কালনার তরুণীর
হ্যাঁ, স্বাধীনতার আগে থেকেই তিনি বর্ণবাদ, ইউজেনিক্স, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা নিয়ে সরব হয়েছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে মুম্বাই-এর ঘিঞ্জি পরিবেশে উপলব্ধ করেছিলেন, প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। তা কেবলমাত্র দেশের সম্পদের যথাযথ বণ্টনের জন্যই নয়, বরং নারী অধিকারের প্রেক্ষিতেও। এ-বিষয়ে তাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলেন মুম্বাই-এর এক মহিলা চিকিৎসক। ১৯৪২ সালে জনসংখ্যা এবং জন্মহার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একটি বিশেষ প্রবন্ধ, বা বলা ভালো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ওয়াদিয়া। যা, আলোকপাত করেছিল অনিয়ন্ত্রিত জন্মহারের নেতিবাচক দিকগুলোতে। সেইসঙ্গে একাধিক সমাধান সূত্রেরও হদিশ দিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
শ্মশানবন্ধুর ভূমিকায় লড়াই, ‘প্রথা’ ভাঙছেন কোচির মহিলা
তৎকালীন সময়ে ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্বেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল ওয়াদিয়ার এই প্রবন্ধ। সমালোচনার শিকারও হতে হয়েছিল তাঁকে। তবে নিজের দাবি থেকে সরে আসেননি মহীয়সী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর এই দাবিকে স্বীকৃতি জানায় ভারতের নবনির্মিত সরকার। ১৯৪৯ সালে তাঁর দাবি মেনেই তৈরি হয়েছিল ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া। ৩৪ বছর ধরে যে সংস্থার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৫১-৫২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নকারী দেশ হয়ে ওঠে ভারত। গর্ভনিরোধক পদ্ধতির প্রচারই হোক কিংবা নিরোধ ব্যবহার, নির্দিষ্ট সংখ্যক সন্তান প্রজনন— পরবর্তীতে প্রতিটি নীতি প্রণয়ন এবং প্রচারের ক্ষেত্রেই সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে ওয়াদিয়ার।
কিন্তু এমন একজন ব্যক্তিত্ব কেন হারিয়ে গেলেন বিস্মৃতির অতলে? এর পিছনেও রয়েছে রাজনীতি। প্রথমত, সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থার সময়, জোরপূর্বক বন্ধ্যাত্বকরণ-সহ একাধিক কঠোর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই যার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন ওয়াদিয়া। জানিয়েছিলেন, স্বেচ্ছামূলক হতে হবে এই নীতিকে। তখন থেকেই ফাটল ধরেছিল সম্পর্কে। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন তিনি। তখন তিনি ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড পেরেন্টহুড অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি। গর্ভপাতকে পরিবার পরিকল্পনা নীতির মধ্যে আনতে চাননি ওয়াদিয়া। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এই নীতির পরিবর্তন করার প্রস্তাব দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। তাঁর যুক্তি ছিল, “গর্ভপাত ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। জোরপূর্বক গর্ভপাত মানব ও ব্যক্তি অধিকারের পরিপন্থী।” তাঁর এই অবস্থান সার্বিকভাবে প্রভাবিত করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আন্তর্জাতিক অনুদানের পরিমাণকে। এক ধাক্কায় প্রায় ১.৭ কোটি মার্কিন ডলারের অনুদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভারতে।
এই বিতর্কের জেরেই কি তাঁকে ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল সমস্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে? এমনকি ভারতের ইতিহাসও ‘ভুলে’ যায় তাঁকে? জানা নেই উত্তর। তবে ওয়াদিয়া না থাকলে, আজ ভারতের পরিণতিও হত আফ্রিকার মতোই। খাদ্য কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদের চরম সংকট দেখা দিত এ-দেশেও…
Powered by Froala Editor