বিকানেরে শকুন দেখতে গিয়ে শুনেছিলাম, রাজস্থানেও নাকি জালিয়ানওয়ালাবাগ আছে। জায়গাটি সম্পর্কে জেনে বুঝেছি, সেখানকার ইতিহাসও বেশ তাগড়াই। রাজস্থানের মাটিতে এমনিতেও ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়, সেখানকার খেজারালি গ্রামে প্রাণাধিক প্রিয় গাছের প্রাণ বাঁচাতে শহিদ হয়েছিলেন ৩৬৩ জন বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ। চিপকো আন্দোলনের ২৪৩ বছর আগেকার ঘটনা এটি। প্রসঙ্গে ফিরি। আপনারা সবাই নিশ্চয়ই পঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কথা পড়েছেন। ত্যাগীদের রক্তে ভেজা মাটির কারণে পঞ্জাবের অমৃতসর যেমন দেশপ্রেমের অন্যতম তীর্থস্থান, তেমনি রাজস্থানের (Rajasthan) মানগড়ও। মানগড়ে (Mangarh) ব্রিটিশদের টার্গেট ছিল ভিল জনজাতি। ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যের শিকার হয়েছিল হাজারো মানুষ। তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল 'মানব শিকারি' ব্রিটিশ সরকার। লেখক, ইতিহাসবিদ এবং স্থানীয় মানুষের দাবি, ঘটনাটি জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও বড়ো গণহত্যা। কিন্তু, ইতিহাসে এত বড়ো গণহত্যা সে-পর্যায়ে লিপিবদ্ধ হয়নি।
রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার দূরে অদিবাসী অধ্যুষিত বাঁশওয়াড়ার জেলা সদর থেকে মানগড় প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। আনন্দপুরী পঞ্চায়েত সমিতির সদর দফতর থেকে এগিয়ে গেলে প্রায় চার কিমি দূর থেকে একটি পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। ১১০ বছর আগে ঘটে যাওয়া গণহত্যার সাক্ষী এই পাহাড়। লোকজন এখন একে মানগড় ধাম বলে। এই পাহাড়ের প্রায় ৮০ শতাংশ রাজস্থানে এবং ২০ শতাংশ গুজরাতে।
জঙ্গলে ঘেরা মনগড় পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৮০০ মিটার। গণহত্যার পর প্রায় ৮০ বছর এখানে কিছুই ছিল না। সে-সময়ের ইতিহাসও সংরক্ষিত হয়নি। গত দু-দশকে এখানে শহিদ স্মৃতিসৌধ, জাদুঘর ও সড়ক ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। তবে জঙ্গলে ঘেরা মানগড় পাহাড় ১১০ বছর আগে কী অবস্থায় ছিল, এখানে পৌঁছলেই বোঝা যায়। ১৯৯৯-এর ২৭ মে। ঘটনার প্রায় আট দশক পর রাজস্থান সরকার গণহত্যায় নিহত শতাধিক মানুষের স্মরণে একটি শহিদ স্মৃতিসৌধ তৈরি করে। এর ফলে মানগড় কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পায়। কিন্তু, কোনো অজানা কারণে ইতিহাস কখনোই এই হত্যাকাণ্ডকে জায়গা দেয়নি। বাঁশওয়াড়ার বিধায়ক এবং প্রাক্তন আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রী মহেন্দ্রজিৎ সিং মালভিয়া একবার বলেছিলেন, 'মন্ত্রী থাকাকালীন দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে এর ইতিহাস বের করার জন্য আমি পাঁচজনের একটি কমিটি করেছিলাম। খুশি যে, ধীরে ধীরে মানুষ মানগড়ে ঘটে যাওয়া এত বড়ো ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারছে। এখানকার পাহাড়ে গেলেই দেখা মিলবে মানগড় গণহত্যার স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। রয়েছে গোবিন্দ গুরুর মূর্তি। মানগড় সম্পর্কিত তথ্যও পাথরে লেখা রয়েছে।'
১৮৫৮ সালে দুঙ্গারপুর জেলার বাঁশিয়া (বেদসা) গ্রামের বানজারা পরিবারে জন্মেছিলেন গোবিন্দ গুরু। ১৮৮০ সালে তিনি মানুষকে সচেতন করার জন্য একটি আন্দোলন শুরু করেন। তখনকার দিনে স্থানীয় জনগণ ব্রিটিশ শাসন ও তাদের করব্যবস্থা, জবরদস্তিমূলক শ্রম প্রথাসহ বহু নৃশংসতার সঙ্গে লড়াই করছিল। আর সেই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোবিন্দ গুরু। ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বি কে শর্মা বলছেন, 'জোর করে কর আরোপ করা হচ্ছিল। মানুষের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে গোবিন্দ গুরুর আন্দোলন থেকে এক নতুন চেতনা জন্মায়।'
গোবিন্দ গুরু মানুষকে বুঝিয়ে দেন, মদ খাওয়া চলবে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। তাঁর রাশভারী বিচরণের কারণে চুরির ঘটনাও বন্ধ হয়ে যায়। মদ থেকে উঠে আসা আয়ও এরপর কমে যায়। 'ধুনি টেপ তের'-এর লেখক এবং প্রাক্তন আইপিএস অফিসার হরিরাম মীনা বলেছেন, '১৯০৩ সালে গোবিন্দ গুরু সম্প সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।' তাঁর এই প্রচার ভগৎ আন্দোলন নামেও পরিচিত। জনসচেতনতার এই আন্দোলন মহিরুহে পরিণত হয়। রাজ্যের আধিকারিকরা বুঝতে পারে, গোবিন্দ গুরুর নেতৃত্বে ভিল জনজাতির মানুষ আলাদা রাজ্য দাবি করছে।' ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ভি কে বশিষ্ঠও মনে করেন, ভিলরা নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারও বুঝে যায়, স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই আদিবাসীরা। এদিকে, গোবিন্দ গুরুর আন্দোলনের প্রভাব এতটাই তীব্র ছিল, অনেক রাজ্যই ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের আন্দোলন সম্পর্কে অভিযোগ করতে শুরু করে। পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে সে-থেকেই। কয়েক বছর পর, ১৯১৩ সালের ১৭ নভেম্বর মানগড় পাহাড় সাক্ষী হয় নৃশংস গণহত্যার।
রাজস্থান, গুজরাত ছাড়াও ভিল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলবে মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রেও। একদিকে যেমন জমিদারি প্রথার যুগ ভিলদের জন্য সমস্যা তৈরি করে, তেমনই ব্রিটিশ আইনও তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আদিবাসী সমাজের কাছ থেকে জল, বন ও ভূমির অধিকার ছিনিয়ে নিতে ব্রিটিশরা ছিল বদ্ধপরিকর। এমনকী ভিলদের চুক্তিভুক্ত শ্রমিক হিসেবেও ব্যবহার করা হত। ১৮৯৯-১৯০০ সালে ভয়ানক খরার শিকার হয় ডেকান এবং বম্বে প্রেসিডেন্সি। এতে ৬ লক্ষ মৃতের মধ্যে ভিল সমাজের লোক ছিল সবচেয়ে বেশি। বাঁশওয়াড়া এবং সাম্ভরামপুরের মতো রাজ্যগুলিতে সবচেয়ে বেশি পড়েছিল এর প্রভাব। সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং প্রান্তিক সমাজকে মূলস্রোতে আনার প্রচেষ্টা শুরু হয় এরপর। মহাত্মা গান্ধি, বিনায়ক দামোদর সাভারকরের মতো নেতারা দলিতদের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করেছেন। তবে, এই তালিকায় এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নাম গোবিন্দ গিরি ওরফে গোবিন্দ গুরু।
সন্তরামপুরে চুক্তিভুক্ত শ্রমিক বা বন্ড মজুরের কাজ করতেন তিনি। খরার সময় তিনি ভিল সম্প্রদায়ের জন্য প্রাণপাত করে কাজ করেছিলেন। নিষ্ঠুরতা ও খরায় ক্লান্ত হয়ে ভিল সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ সে সময় ডাকাতির আশ্রয়ও নেয়। গোবিন্দ গিরি মনে করতেন, আর্থ-সামাজিক প্রান্তিকতা এবং অ্যালকোহলের প্রতি আসক্তি; এই দু'টিই সম্প্রদায়ের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। এই দুইয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে ১৯০৮ সালে 'ভগৎ অভিযান' শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য ছিল, ভিল সমাজের মধ্যে তাদের চিরন্তন শিকড় মজবুত করা। অনেক এরপর নিরামিষাশী হয়ে ওঠে। ছাড়ে মদ্যপানও। গোবিন্দ গিরি তাদের কেবল চুক্তিভুক্ত শ্রমিক হিসেবে কাজ না-করার পরামর্শই দেননি, নিজ অধিকারের জন্য লড়াই করার চেতনাও জুগিয়েছিলেন। দুঙ্গারপুর, বাঁশওয়াড়া ও সাম্ভরামপুরের মতো অঞ্চলগুলো ভিল সমাজের এই উন্নতি ভালো চোখে দেখেনি। ভিল সমাজ তাদের জন্য নিজ রাজ্য এবং ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাদের মজুরির জন্য ন্যায্য পারিশ্রমিক দাবি করতে শুরু করে। অনেকে তো বড়ো মজুরের কাজও বন্ধ করে দিয়েছিল। এর প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতেও।
১৯১৩ সালের অক্টোবরে গোবিন্দ গিরি ভিল সঙ্গীদের নিয়ে মানগড়ে পৌঁছান। সেটা ছিল কার্তিক মাস।বাঁশওয়াড়া এবং সাম্ভরামপুর রাজ্যের মধ্যে মানগড় জঙ্গলে, এক উৎসবের আয়োজন করেন তিনি। আমন্ত্রণ জানান তাঁর অনুসারীদের। কার্তিক পূর্ণিমার সেই দিনটি ছিল ১৩ নভেম্বর। একে ত্রিপুরারি পূর্ণিমাও বলা হয়। দেব-দীপাবলি উৎসবও পালিত হয় এই দিনে। সেদিন একটি বড়ো যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল মানগড়ে। মানগড়ে হাজির হয়েছিল লক্ষাধিক ভিল সম্প্রদায়ের মানুষ। এই আবহের মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ভিলরা নাকি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিকে উৎখাত করে তাদের নিজস্ব আলাদা রাজ্য গঠন করতে চায়।
ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত তৎকালীন চিঠিগুলি থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ সরকার ১৩ এবং ১৫ নভেম্বর গোবিন্দ গুরুকে মানগড় পাহাড় খালি করতে বলে। তবে গোবিন্দ শুরু যজ্ঞের জন্য সেখানে লোক সমাগমের কথাই বলেন। অধ্যাপক অরুণ বাঘেলার ব্যাখ্যা, 'গুজরাতের কুন্ডা, বাঁশোয়ারার ভূখিয়া, বর্তমান আনন্দপুরী এবং মোর্চা উপত্যকা থেকে মানগড় সেনাবাহিনী দ্বারা বেষ্টিত ছিল।' জানা যায়, ঘটনাটি পরিদর্শনের জন্য পাঠানো হয় রে হ্যামিল্টন নামে এক ব্রিটিশ অফিসারকে। যজ্ঞ থামানোর জন্য শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ভিলদের দমন করার জন্য বাঁশওয়াড়া, দুঙ্গারপুর এবং সাম্ভরামপুরের সম্মিলিত বাহিনী পৌঁছায় মানগড়ে। পাহাড় ঘেরাও করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সামরিক অফিসার কর্নেল শেরাটন এবং মেজর এস বেইলি ছাড়াও ক্যাপ্টেন ই স্টিলি এই দমনমূলক অভিযানের অগ্রভাগে ছিলেন।
প্রথমে মেশিনগান আর বন্দুক উচিয়ে ভিলদের এই জায়গাটি খালি করতে বলা হয়। তবে তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। দলিত ভিলরা স্থান ত্যাগ করেনি। স্থান ত্যাগ করলে তা হত আত্মসমর্পণ। এর পর চারদিক থেকে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। পরিসংখ্যান বলছে, সেদিন ১০০০-১৫০০ ভিল প্রাণ হারায় এই গণহত্যা। গ্রেপ্তার হন গোবিন্দ গিরি-সহ বহু ভিল নেতা। ১৯১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোবিন্দ গিরিকে ব্রিটিশ আদালত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। তবে ভালো আচরণ এবং জনপ্রিয়তার কারণে ১৯১৯ সালে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। সে-বছরই ঘটেছিল জালিয়ানওয়ালা বাগের গণহত্যা। যদিও জেল থেকে ছাড়া পেলেও, যে-সব রাজ্যে তাঁর সবচেয়ে বেশি অনুসারী ছিল, সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল গোবিন্দ গিরির। ১৯৩১ সালে গুজরাতের নিম্বডির কাছে দেহাবসান হয় কিংবদন্তি ভিল নেতার। তারপর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান গোবিন্দ গুরু। ইতিহাস মনে রাখেনি তাঁর সংগ্রামের কথা।
Powered by Froala Editor