তিরিশের দশকের শেষ দিক সেটা। কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র। বিশ্বাস একমাত্র সশস্ত্র আন্দোলনের পথেই স্বাধীনতা আনা সম্ভব ভারতবর্ষে। পাশাপাশি ভারতভাগের প্রস্তাব কংগ্রেসের অনেক শীর্ষ নেতৃত্ব মেনে নিলেও, স্পষ্টতই নেতাজির মতবিরোধ ছিল তা নিয়ে। তবে সেদিন কংগ্রেসে থেকেও, নেতাজির এই নতুন ‘পথচলা’-কে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনি। অকুণ্ঠিতভাবেই জানিয়েছিলেন, তরুণ প্রজন্মও এগিয়ে আসবে তাঁর এই উদ্যোগে। আর সেই সূত্রেই তিনি নেতাজির প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দলের নামকরণ করেছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক।
পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। পরাধীন ভারতের সংসদে যে তিন বাগ্মী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামে তো বটেই, স্বাধীনতার পরেও ভারতীয় রাজনীতির জগতে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। কিন্তু ক’জন বাঙালিই বা মনে রেখেছে তাঁর কথা?
পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জে ১৮৮৫ সালে জন্ম লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের। বাংলাদেশে বড়ো হয়ে উঠলেও পরবর্তীতে পড়াশোনার সূত্রেই কলকাতায় চলে আসেন লক্ষ্মীকান্ত। অন্যদিকে পারিবারিক ব্যবসার সূত্রে নদীয়াতে স্থায়ী বসতিস্থাপন করেন তাঁর বাবা। প্রেসিডেন্সি কলেজ স্নাতকতা করার পর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজ থেকে বি.এল পাশ করেন লক্ষ্মীকান্ত। পরবর্তীতে সংস্কৃত কলেজ থেকে সাহিত্যে কাব্যসাংখ্য এবং কাব্যতীর্থ ডিগ্রিলাভ করেন।
একাধিক বিষয়ে পারদর্শী হলেও, পেশাগতভাবে আইনকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আইনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। গোটা ভারতে তাঁর কৃতিত্ব ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি খুব বেশি। আর সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের মতো ব্যক্তিত্বদের। ভারতের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ঔপনিবেশক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইকে একেবারে কাছ থেকে দেখা সেইসময়ই।
আরও পড়ুন
প্রয়াত নেতাজির সহযোদ্ধা লালতি রাম, করোনা কেড়ে নিল আইএনএ সেনাধ্যক্ষকেও
সেই লড়াইতে সামিল হওয়ার আহ্বান এল তাঁর কাছেও। না, সেই প্রস্তাব ফেরাননি তিনি। বরং, আইনি ব্যবসা ছেড়েই তিনি যোগ দিলেন গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে। সেটা ১৯২১ সাল। তারপর জড়িয়ে পড়া সক্রিয় রাজনীতিতে। যদিও কলেজে পড়াকালীন সময়েই তাঁর আলাপ হয়েছিল সুভাষচন্দের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
‘বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি নেতাজি’, রিপোর্ট দিয়েও 'অবহেলিত' বিচারপতি মনোজ মুখার্জি!
তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড ভারতভাগের প্রস্তাব দিলে দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায় কংগ্রেস। অনেকে সমর্থন করেন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নতুন দুই রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার এই প্রস্তাব। তবে চুপ থাকেননি পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। সেসময় অখণ্ড ভারতের দাবিতে কংগ্রেস ছেড়েছিলেন তিনি। বদলে যোগ দেন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় কংগ্রেস দল’-এ। ১৯৩৬ সালে বাংলা থেকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে সাংসদে নির্বাচিতও হন তিনি। পরবর্তীতে ভারতীয় সংবিধান রচনার কমিটিতেও অন্যতম সদস্যের ভূমিকা পালন করেছেন লক্ষ্মীকান্ত।
আরও পড়ুন
নেতাজির ছবি থাকুক নোটে, আবেদনের নিষ্পত্তি করতে কেন্দ্রের দ্বারস্থ মাদ্রাজ হাইকোর্ট
তবে আটকানো সম্ভব হয়নি ভারতভাগ। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা এল ঠিকই। তবে নদীয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানের সীমারেখার ভিতরে। যার মধ্যে ছিল শান্তিপুরও। শুরু হল স্বাধীনতার পর এক নতুন লড়াই। শান্তিপুরকে ভারতে ফেরানোর লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র। সফলও হলেন। আধুনিক শান্তিপুরের জন্মও তাঁর হাতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আদর্শে শান্তিনিকেতনের আদলে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিপুর কলেজ। তাছাড়াও শিক্ষাপ্রসারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্ত। শান্তিপুর রেলস্টেশন এবং তৎসংলগ্ন জমিও তাঁরই দান করা। পাশাপাশি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানেও তাঁর কৃতিত্ব ছিল অকল্পনীয়।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই হোক কিংবা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু— শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে কোনোদিনই কণ্ঠ কাঁপেনি তাঁর। তাই নিজের শহরেও শত্রুপক্ষের অভাব ছিল না লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের। এহেন ব্যক্তিত্বের বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে যাওয়ার কারণ কি সেই প্রতিবাদী অবস্থানই? উত্তর জানা নেই।
তথ্যসূত্রঃ একশো পঁচিশে সংসদের বাঙালি পণ্ডিত, হারাধন চৌধুরী, বর্তমান পত্রিকা
Powered by Froala Editor