১৯ বছর বয়সে শহিদ, বিস্মৃতির অতলে ‘সিন্ধের ভগৎ সিং’

১৯৩০ সালের কথা। সে-বছরই ২৬ জানুয়ারি লাহোরে ভারতের তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেছেন জওহরলাল নেহরু। তার কিছুদিন পরই আরও এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী থেকেছিল পশ্চিম ভারতের সিন্ধ। দেখেছিল এক অদ্ভুত প্রভাতী পদযাত্রা। স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট কিশোর-কিশোরীরা সেদিন সামিল হয়েছিল রাস্তায়। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতা, দেশপ্রেমের সুর। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই পদযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক ৭ বছর বয়সি কিশোর।

হিমু কালানি (Hemu Kalani)। মাত্র ১৯ বছর বয়সে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নিয়েছিলেন সিন্ধের এই তরুণ। তাঁর কৈশোরের কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। অবশ্য বিস্মৃতপ্রায় এই স্বাধীনতা সংগ্রামী পাকিস্তান ও পশ্চিম ভারতে পরিচিত ‘সিন্ধের ভগৎ সিং’ (Bhagat Singh Of Sindh) নামেই। 

১৯২৩ সালের ২৩ মার্চ। সিন্ধের শুক্কুরে জন্মগ্রহণ করেন হিমু। আশ্চর্যজনকভাবে এর ঠিক ৮ বছর পর একই দিনে শহিদ হয়েছিলেন ভগৎ শিং। যাক সে কথা। কিশোর বয়স থেকেই হিমুর বড়ো হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের বাণী এবং বিপ্লবীদের গল্প শুনে। একাধিক গান্ধীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁর বাবা পেসুমলও। ফলে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া যেন একপ্রকার ভবিতব্যই ছিল হিমুর। 

তিরিশের দশকের শেষের দিক সেটা। হিমু তখন সিন্ধের তিলক কলেজের ছাত্র। এক ব্রিটিশ সাহেবের নির্দেশ উপেক্ষা করায় গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল তাঁর বাবাকে। এই ঘটনাই এক লহমায় বদলে দেয় তাঁর জীবন। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে অস্ত্র তুলে নেন হাতে। যোগ দেন স্বরাজ্য সেনা মণ্ডলে। ভগৎ সিং-এর হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের পর পশ্চিম ভারতের অন্যতম বিপ্লবী সংগঠন ছিল এটিই। 

একদিকে যেমন স্বদেশি গ্রহণ ও বিদেশি পণ্য বয়কটের মতো প্রচারের আড়ালেই চলত তাঁর যুদ্ধের প্রস্তুতি। তবে একদিন না একদিন যে ধরা পড়তেই হবে, তা ভালো মতোই জানতেন তরুণ বিপ্লবী। তবে হিমু নয়, দেশদ্রোহের অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁর বেশ কয়েকজন সহবিপ্লবীকে। চল্লিশের দশকের শুরুর দিক সেটা। তাঁদের মুক্ত করতে থানা ঘেরাও করে গণপ্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন হিমু। তার পরই নাটকীয় মোড় নেয় পরিস্থিতি। কোনোরকম সতর্কবার্তা ছাড়াই অবস্থানকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে ব্রিটিশ পুলিশ। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়। তবে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে গেলেও, হার মানেননি হিমু। এর কয়েকদিন পরেই তাঁর নেতৃত্বে থানায় সশস্ত্র আঘাত হানেন স্বরাজ্য সেনা মণ্ডলের বিপ্লবীরা। সবমিলিয়ে সেই যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন ৪০-এর বেশি ব্রিটিশ পুলিশ। 

এর ঠিক পর পরই ১৯৪২-এর ৮ আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেন গান্ধীজি। দেশের প্রায় সমস্ত প্রান্তেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আন্দোলন। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, সীমান্ত গান্ধী ছাড়াও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সমস্ত নেতাকেই কারাগারে বন্দি করে ব্রিটিশ সরকার। তবে তাতে দমানো যায়নি এই আন্দোলনের আগুনকে। বিদ্রোহ দমন করতে বহু জায়গাতেই নৃশংস হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকার। ক্রমশ বাড়তে শুরু হয় অস্ত্রের ভাণ্ডার।

পশ্চিমভারতের বালুচিস্তানেও ঘটেছিল একই ঘটনা। দিল্লি থেকে ব্রিটিশ সরকারের অস্ত্র বোঝাই ট্রেন পৌঁছানোর কথা ছিল সেখানেও। ১৯৪২-এর ২৩ অক্টোবর গোপন সূত্রে সেই খবর পৌঁছায় হিমুর কাছে। দুই সঙ্গী নিয়ে সেই ট্রেন লুঠ করতেই সিন্ধের রোহিণী স্টেশনে হাজির হন হিমু। পরিকল্পনা ছিল ট্রেন লাইনচ্যুত করা। তবে তার আগেই ব্রিটিশ পুলিশবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে তরুণ বিপ্লবীদের। বিশাল পুলিশ বাহিনীর সামনে একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল পরাজয়। তবে কি তিনজনকেই প্রাণ দিতে হবে? না, প্রাণ দিতে দ্বিধা ছিল না কারোরই। কিন্তু পরবর্তীতে আন্দোলন জারি রাখার জন্য দুই সঙ্গী— নন্দ এবং কিষাণকে পালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন হিমু। বরং, নিজে ধরা দেন ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে। বন্দি অবস্থায় অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হয়েও আন্দোলনের পরিকল্পনা কিংবা সঙ্গীদের নাম প্রকাশ করেননি হিমু। শেষে ১৯ বছর বয়সে হাসতে হাসতেই ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নিয়েছিলেন তিনি। 

১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীনের পর কাঁটাতার উঠে যায় ভারতের বুকে। সিন্ধ হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ। তবে আজও রাজস্থান, গুজরাট কিংবা পাঞ্জাবের মানুষ মনে রেখেছেন ‘সিন্ধের ভগৎ সিং’-এর এই কাহিনি। শুধু পাঠ্য বই থেকেই ব্রাত্য থেকে গেছেন তিনি…

Powered by Froala Editor