“অরণ্য কী?” একটি আপাত নিরীহ প্রশ্ন মনে হলেও বিশ্বজুড়ে যথেষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোড়ন বারবার তুলেছে এর নির্দিষ্ট সংজ্ঞা। যদি আমাদের দেশের দিকেই তাকানো যায়, তা হলেও এর উদাহরণ নেহাত কম কিছু নেই। তবু এই প্রশ্নটা হয়তো উঠতই না, যদি না সাধারন একটা মানুষ আর তার একটা আবেদন নাড়িয়ে দিয়ে যেত দেশের অরণ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন।
ভারতের দক্ষিণভূমি। নীলগিরি পর্বতমালা সংলগ্ন জঙ্গলগুলোর উপর চিরকালই নির্ভরশীল ছিল বেশ কয়েকটি উপজাতি সম্প্রদায়। গুদালুর অরণ্য তাদের মধ্যে অন্যতম। এই গুদালুর চিরহরিৎ অরণ্যের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল কাট্টুনায়কন উপজাতির মানুষেরা। গাছের ডালপালা, মধু সংগ্রহ করতে জঙ্গলই ছিল তাদের আশ্রয়। এবং, যেন ধর্মস্থানও। ধরা যাক, মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে হঠাৎ কোনো মৌচাক খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু তা হলেও কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না তারা। নিয়ম নেই। বরং প্রার্থনা করবে। আর্জি জানাবে। কার কাছে? ওই বৃক্ষের কাছেই। গাছগুলি কাট্টুনায়কন উপজাতির আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের রক্ষাকারী।
গুদালুরের এই বনাঞ্চলে কাট্টুনায়কনদের এই প্রথা অভিভূত করেছিল তরুণ টিএন গোদাবর্মনকে। গোদাবর্মন ছিলেন মালায়ালি জমির মালিকদের পরিবার কোভিলাকাম বংশের সন্তান। রাজ্য জমি অধিগ্রহণ করার আগে যারা ছিলেন নীলগিরিতে প্রায় ৮০ হাজার একর বনের একচ্ছত্র মালিক।
ফাস্ট ফরওয়ার্ডে বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়া যাক। ৭ এপ্রিল, ১৯৯৫। গুদালুরের জঙ্গল থেকে নির্বিচারে কাঠ কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নীলগিরির আদিবাসী জনজাতি মানুষদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সুপ্রিমকোর্টে একটি মামলা দায়ের করলেন গোদাবর্মন। তিনি তখনও জানতেন না যে এই পিটিশন পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের জন্য ভারতীয় পরিবেশনীতি এবং বিচার ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়ে যাবে। শুরু করবে একটি বিস্তীর্ণ এবং জটিল আইনি প্রক্রিয়া। প্রায় ২৫ বছর ধরে ‘টিএন গোদাবর্মন বনাম ভারত এবং অন্যান্যরা’— এই মামলায় জড়ো হয়েছে প্রায় ৬০০০ অ্যাপ্লিকেশন এবং ১১৭০ অর্ডার। ৮৮ জন বিচারক বিবেচনা করেছেন এর কেন্দ্রীয় প্রশ্ন: ‘অরণ্য কী’?
আরও পড়ুন
গাছে-গাছে ঝুলছে ভয়ঙ্কর সব পুতুল, স্ট্যাফোর্ডশায়ারের অরণ্যের রহস্য আজও অমীমাংসিত
এই প্রশ্নের উত্তরে খোদ নিজেকে দেশের জঙ্গল এবং বন্য জীবনের অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ করতে হয়েছে আদালতকে। অরণ্যের অধিকার সংক্রান্ত মূল যে প্রশ্নগুলি সামনে রেখে এগনো হয়েছে, সেগুলি হল: কাদের অধিকার আছে জঙ্গলে? কীভাবে সংগ্রহ করা হবে বনজদ্রব্য? কখন সেগুলো সংগ্রহ করার একদম সঠিক সময় এবং কেন অরণ্যের সুরক্ষা দরকার?
একইসঙ্গে প্রশংসা এবং বিতর্ক দুটোই শুরু হয় এই মামলা ঘিরে। একদিকে যেমন বলা হয় গোদাবর্মনের এই মামলার কারণে আদিম জমিগুলি সংরক্ষণ করা আর রাষ্ট্রের হাতে না ছেড়ে জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনই আবার অন্যদিকে বলা হয়, এই মামলা আসলে কয়েক হাজার বনবাসীকে উচ্ছেদের প্রশ্রয় দিয়েছে।
আরও পড়ুন
অনুপ্রেরণায় দশরথ মাঝি, ‘মরুভূমি’কে একা হাতে অরণ্যের চেহারা দিলেন বিহারের ব্যক্তি
নতুন শতকে ভারতীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এই মামলাটি। কোনটার গুরুত্ব বেশি, অর্থনীতি নাকি পরিবেশ আর বাস্তুশাস্ত্র? বন্যজীবন সংরক্ষণ ও উপজাতির অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলনের দর্শনগুলির মধ্যে বিভেদ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছিল এই বিতর্ক। এই সবকিছুর মাঝে টিএন গোদাবর্মন শুধু বলেছিলেন, “আমি তো মাত্র কিছু গাছকেই বাঁচাতে চেয়েছিলাম!”
অরণ্য সংক্রান্ত আইনের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯২৭ সালের ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট (আইএফএ) রাজ্য সরকারগুলিকে তাদের মালিকানাধীন যে জমি আছে, তাকে ‘সংরক্ষিত অরণ্য’ হিসাবে ঘোষণা করার অনুমতি দেয়। তবে, এই জাতীয় ঘোষণা দেওয়ার আগে যে শর্তগুলি পূরণ করতে হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে কিছুই বলা হয়নি। পরবর্তীকালে রাজ্যগুলি এই জমি কৃষি বা শিল্পকাজের জন্য ‘ডাইভার্ট’ করতে ব্যবহার করে। এর ফলে দেখা যায়, ১৯৫১ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে হারিয়ে গেছে প্রায় ৪৩,০০০ বর্গকিলোমিটার বন, যা আকারে হরিয়ানার সমতুল্য।
আরও পড়ুন
প্রতি মিনিটে দুটি ফুটবল মাঠের আয়তনের অরণ্য লোপ, ভয়ংকর পরিস্থিতি ব্রাজিলে
হুঁশ যখন ফেরে, দেরি হয়ে গেছে তখন। সেই সময়েই গোদাবর্মনের চিঠি নড়িয়ে দেয় পরিবেশবিদ এবং আদালত তথা সরকারকেও। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে আদালতের নির্দেশে রাজ্য সরকারগুলির কাছে বার্তা যায়, বনভূমিগুলিতে সমস্ত অ-বনজ কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। এর ফলে যেমন চোরাকারবারীরা বিপদে পড়ে, তেমনই সমস্যায় পড়ে জনজাতিরাও। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল।
এই আদেশের একটি অনুলিপি পোস্ট করে পাঠানো হয় গোদাবর্মনের বাড়ির ঠিকানায়। এই আদেশের ফলে গুদালুরের বেআইনি কাঠের ব্যবসায় জড়িত চোরাকারবারী এবং ক্ষমতাশালীরা ফেটে পড়ে ক্ষোভে। নিয়মিত হুমকি আসতে থাকে তাঁদের পরিবারের কাছে। স্যুইটকেস ভর্তি টাকা পাঠিয়ে লোভ দেখানোর চেষ্টাও কম হয়নি। একবার বাধ্য হয়ে গোদাবর্মনকে এমনকি তাক করতে হয়েছিল একে-৪৭ রিভলবারও। বলেছিলেন: “এই বন্দুকটিতে ছয়টি গুলি রয়েছে। পাঁচটা আমি আপনাদের জন্য রাখছি; শেষটা আমার জন্য রইল। আমি বুড়ো এবং আমার হারানোর কিছুই নেই। আপনি কী হারাবেন, তা ভেবে দেখুন!”
১৯৩০ সালে জন্ম গোদাবর্মনের। তাঁর ভাইবোনেরা অন্য কাজ বা ব্যবসা শুরু করলেও, গোদাবর্মন তাঁর পরিবারের জমি দেখাশোনার বাইরে নিয়ে যাননি নিজেকে। গোদাবর্মনের বড়ো ছেলে এবং স্থানীয় কলেজের লেকচারার রাজেন্দ্রর কথায়, “বাবা এই অরণ্যের প্রতিটা ইঞ্চি চিনতেন, বুঝতেন। নিজেকে সত্যিকারের অরন্যের রক্ষক হিসেবেই মনে করতেন তিনি।”
কিন্তু কতটা কাজ দিয়েছে সেই চেষ্টা, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা যায় না কিছুতেই। তাই হয়তো কিছুতেই সামনে আসে না এরকম একটা মানুষের নাম, যিনি গোটা একটা আইন পরিবর্তন বা প্রবর্তন করানোর মতো পাগলামি করতে পেরেছিলেন। হিসেব বলছে, ২০০২ থেকে ২০০৪ এর মধ্যে, হাতি, বুলডোজার এবং প্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্রপাতিগুলির শক্তি কমপক্ষে ৩,০০,০০০ লোককে ভারতের বন থেকে উচ্ছেদ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এগুলিকে সহজেই বর্বরতা বলা যেতে পারে না কি? ২০০৪ সালের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযানগুলি আদিবাসীদের আবাসভূমি সহ ১.৫২ লক্ষ হেক্টর বন-জমি দখল করেছে। তারপরের হিসেব করতে বসলে বাতাসে অক্সিজেন আরও একটু কম লাগবে নিশ্চয়ই!
২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে বাম-কংগ্রেসের ইউপিএ জোট। আড়াই বছর পর ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ‘বন অধিকার আইন’ (এফআরএ) প্রণয়ন করা হয় একটি ‘ঐতিহাসিক অন্যায় সংশোধন’ করার জন্য। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের জায়গায় নতুন এই আইন প্রয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয় উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়কে। এই নিয়েও কম হয়নি জলঘোলা।
আইনটি বাস্তবায়ন নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এমনকি ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নেহাতই অবহেলিত। তুলনায় অনেক স্বল্পসংখ্যক কর্মচারী নিয়ে এটি প্রায় ধুঁকছে বলা যায়। তাই খাতায়-কলমে এই দফতরের উপর বহু দায়িত্ব থাকলেও তাদের অবস্থা কী, সেটা আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়। জঙ্গলের উপর ঠিক কার ‘অধিকার’ এবং কে যে ‘দখলদার’, তৃণমূল পর্যায়ে এখনও সেটা ঠিক করার দায়িত্ব তাই রয়ে গেছে আমলাতন্ত্রেরই হাতে।
Powered by Froala Editor