নেভিল কার্দাস স্কোরবোর্ডকে বলেছিলেন 'গাধা'। সে-উপমা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, অতীতের বিস্মৃত কাহিনির ভেতর ঢুকে পড়ার জন্য স্কোরবোর্ডের যে বিশ্বস্ত, এ-কথায় অন্তত দ্বিমত নেই। ধরা যাক, আজ থেকে বছর কুড়ি পরে যদি কোনো প্রৌঢ় তাঁর উত্তরপ্রজন্মকে জিজ্ঞেস করলেন- 'গোপাল বসু কে?'
এর উত্তরে খুব বেশি হলে উঠে আসবে কয়েকটি শব্দবন্ধ, যেমন- 'প্রাক্তন বাঙালি ক্রিকেটার', 'একটি মাত্র আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা বাঙালি ব্যাটসম্যান' ইত্যাদি। কিন্তু সত্তরের উত্তপ্ত কলকাতার বুকে সাদা হাতা গোটানো শার্ট আর প্যান্ট পরে সকালে কেউ ক্রিকেট খেলতে নামছেন - এর মাদকতা একেবারেই স্কোরবোর্ডের ধারপাশ দিয়ে যায় না। বিলাসিতা বললেও হয়তো বাতুলতা হবে না। কিন্তু ক্রিকেটে কি বাঙালি সত্তর দশকে হাতেখড়ির সুযোগ এসেছিল? না তো!
সেই কবে প্রবীর সেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বাঙালিকে সর্বভারতীয় ক্রিকেটে একটা খুঁটি দিয়েছিলেন। মন্টু ব্যানার্জি, এক টেস্ট বিস্ময় সুঁটে ব্যানার্জি হয়ে প্রথম সুপারস্টার পঙ্কজ। পঙ্কজ রায়ের পঞ্চাশের দশকটাই প্রথম বাঙালির জাতীয় স্তরে ক্রিকেটে কিছুটা চওড়া জায়গা করে দিল। কিন্তু এরপরেও গোপাল বসু কেন স্বতন্ত্র? কোথায়ই বা তার স্কোরবোর্ডের ব্যারিকেড ভেঙে উঠে আসা রূপকথার পাতায়?
একাত্তরে অজিত ওয়াদেকারের ঐতিহাসিক ক্যারিবিয়ান সিরিজই ভারতীয় ক্রিকেটের মসনদে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল এক জিনিয়াসকে, তিনি সুনীল মনোহর গাওস্কর। গাওস্করের উত্থানের একেবারে সমান্তরাল উত্থান কিন্তু হচ্ছিল এই বাংলাতেই আর এক ওপেনারের, তিনিই গোপাল বসু। কিন্তু গোপাল বসুর ওপেনিং ব্যাট হয়ে ওঠার লড়াইটা কোথাও গিয়ে যেন শুরুতেই কঠিন হয়ে গিয়েছিল আরও। ঘরোয়া ক্রিকেটে অফস্পিনার হিসেবে জীবন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। যখন প্রসন্ন বা ভেঙ্কটরাঘবনের উত্তরসূরি হিসেবে তাঁকে ভাবা শুরু হল, বাইশ গজের বৃত্তে তখনই চাকিং-এর অভিযোগে বিদ্ধ হন গোপাল। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে পূর্ণ সময়ের ওপেনারে পাল্টে ফেলার যে কাহিনি তা শুধু বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাস না, সারা দেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই বিরল।
আরও পড়ুন
১২০ বছর আগে, অলিম্পিকে খেলা হয়েছিল ক্রিকেটও; স্বর্ণপদক জিতেছিল কোন দেশ?
তবে ওপেনার হবার পরও গোপালের ক্রিকেটীয় প্রতিভা শান দেওয়া চাকুর মতোই চকচক করে উঠল গ্রিপে। বাঙালি ক্রিকেটারদের মধ্যে যে লর্ডসের অভিষেক সেঞ্চুরি সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে চলে গেল কোনো দূরতর দ্বীপে, যেখান থেকে সাফল্যের সমুদ্র পেরিয়ে আর ফিরে আসা যায় না বৃত্তের শুরুর বিন্দুটায়, ঠিক সেই অভিষেক সেঞ্চুরির মালিক প্রায় দু দশক আগেই হবার কথা ছিল এই গোপাল বসুর৷ জাতীয় দলের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কলম্বোতে অভিষেক হয় গোপাল বসুর। ১১৪ রানে পিছিয়ে পড়া সেই টেস্ট সুনীল গাওস্করের সাথে জুটি বেঁধে ১৯৪ রান করে ভারতকে ফিরিয়ে আনেন তিনি। নিজে করেন ১০৪ রান। পরের ইনিংসেও করেন ৫৪ রান। কিন্তু এই টেস্টটিকে 'সরকারি স্বীকৃতি' দেওয়া হল না। ফলত ভারতের টেস্ট ক্যাপটিতেও আর খোদাই হবার সুযোগ হল না দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওপেনারের নাম। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন পরের সরকারি টেস্টগুলিতে সুযোগ হল না গোপালের?
চুয়াত্তরের ইংল্যান্ড সফরের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতীয় একাদশ ও অবশিষ্ট ভারতীয় দলের হয়েও ৭৭ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেছিলেন গোপাল। ইংল্যান্ডে ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, ইডি সোলকার, মুম্বই-এর সুধীর নায়েকদের সুযোগ হল সুনীল গাওস্করের সঙ্গে ইনিংস ওপেন করার। কিন্তু সেই লজ্জাজনক ইংল্যান্ড সফর বা যাকে ভারতীয় ক্রিকেটের দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে লর্ডসে ৪২ রানে অলআউটের জন্য 'সামার অফ ফর্টি টু' বলা হয়, সেই সফরে এক টেস্টেও দলে ঠাঁই হল না গোপাল বসুর। অথচ তার কিছুদিন আগে ১৯৭৩-৭৪ ইরানি ট্রফিতে ১৭০ রান করেছিলেন তিনি। সেই ইনিংসের পর ভারতের প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকাই নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিল, বেঁটে মারাঠি জিনিয়াসের ওপেনিং-এর সঙ্গী পেয়ে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেট!
আরও পড়ুন
‘আমাকেও একা করে রাখা হয়েছিল’, বর্ণবৈষম্যের প্রসঙ্গে মুখ খুললেন প্রাক্তন ক্রিকেটার এনতিনি
ললাটলিখন বড়ো অদ্ভুত জিনিস। বাঙালির সর্বভারতীয় ক্রিকেটে বঞ্চনার ইতিহাসে সৌরভের দল থেকে বাদ পড়া নিয়ে যত কথা হয়েছে, গোপাল বসুর সুনীল মনোহর গাওস্করের সঙ্গে ভারতের ইনিংস ওপেন করার রূপকথা ভেঙে যাওয়ার গল্প নিয়ে কথা হয়নি তার সিকিভাগও।
তবে গোপাল বসু মানে ক্রিকেটের বাইরেও এক নিঃশব্দ অভিমানী বাঙালি যুবক। চুয়াত্তরে হারের পর অজিত ওয়াদেকারের থেকে ক্যাপ্টেন্সি যখন ফের হাতবদল হয়ে আসে নবাব পতৌদির কাছে, শোনা যায় ট্রেন জার্নির সময় পতৌদির সিগারেট লাইটার দিয়ে জ্বালাতে অস্বীকার করেন গোপাল। তুড়ি মেরে লাইটার চাওয়ায় অপমানিত হন, গর্জে ওঠেন গোপাল। পতৌদি যে ওঁকে মাদ্রাজ টেস্টে দলে না নিয়ে সোলকারকে দিয়ে ওপেন করান, তার কারণও সম্ভবত ক্যাপ্টেনের সামনে প্রতিবাদের ঔদ্ধত্য দেখানোই। যদিও গোপাল বসুকে অভিমান করতে দেখা যায়নি এ নিয়ে কোনোদিন। হয়তো জীবনের একমাত্র টেস্ট খেলার আশাটাও সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল তার।
আরও পড়ুন
মতি নন্দী, কলাবতীর ক্রিকেট ও একটি সত্যি-গ্রামের গল্প
তবু, ছোটোগল্প হতে চেয়েও ছোটোগল্প না হতে পারার যে বেদনা তাই যেন গোপাল বসুর জীবন। সে জন্যেই হয়তো ক্রিকেট ঈশ্বরের একটা রেকর্ড আজও থেকে গেছে তাঁর নামে যা ভাঙতে পারবে না কেউ। এই টেস্ট দলে সুযোগ না পাওয়ার ট্র্যা জেডির মাঝেই ভারতের হয়ে জীবনের একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচটি খেলে ফেলেছিলেন গোপাল। ব্যাট হাতে ওয়ান ডাউনে ১৩ রান আর বল হাতে ১১ রান দিয়ে ডেভিড লয়েডের উইকেট!
ভারতের প্রথম বাঙালি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে থেকে গেল গোপাল বসুর নাম। শরদিন্দু মুখার্জিরও আগে, প্রথম বাঙালি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্যাপটির মালিক আজীবনের জন্যই থেকে গেলেন ট্র্যাজজিক নায়ক গোপাল বসু, আর থেকে গেল ঘরোয়া ক্রিকেটে ৮টা সেঞ্চুরি, ১৭টা হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডবুক। নিজের ক্রিকেটজীবনে এরপর বাংলার হয়ে অল্প খেললেও অচিরেই বাইশ গজ থেকে হারিয়ে গেলেন গোপাল। থেকে গেল একটা অসমাপ্ত গল্পের পাণ্ডুলিপি আর পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতোই প্রথম বাঙালির একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের খেতাব।
আরও পড়ুন
খেলরত্নের জন্য মনোনীত রোহিত, অর্জুন পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় তিন ক্রিকেটার
যা পাওয়ার ছিল, যে ইতিহাস লেখা হল না কোনোদিন, তার হিসেব কখনোই থাকবে না স্কোরবোর্ডে। তাই উত্তরপ্রজন্মের কাছে গোপাল বসুকে কোন ক্রিকেট রসিক কোন পথ ধরে খুঁজবেন - তা সময়ের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাক না হয়...
Powered by Froala Editor