এক ভুলে যাওয়া মার্কিন শহর ও সর্পিল নদীর কিসসা

একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে মেক্সিকো। আর এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিভেদসীমা হয়ে বয়ে চলেছে রিও গ্রান্ডে (Rio Grande River) নদী। আর এই নদীর ধারেই অবস্থিত ছোট্ট একটি শহর রিও রিকো (Rio Rico)। স্থানীয়দের মুখে যা পরিচিত লা-ফন্টেরা নামে। তবে এই ছোট্ট শহরটি আদতে কোন দেশের অধীনে— তা নিয়েই তৈরি হয়েছিল এক আশ্চর্য জল্পনা। এমনকি নগরবাসীরাও জানতেন না, তাঁরা আসলে কোন দেশের নাগরিক!

শুনতে খানিক অদ্ভুত লাগলেও সত্যি। ১৯৬৭ সাল। প্রশাসনিক কার্যকলাপের জন্য বিশেষ নথি প্রকাশ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর তাতেই নথিভুক্ত হয়েছিল, লা-ফন্টেরা অর্থাৎ রিও রিকো শহর নাকি যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে। অথচ, বছরের পর বছর ধরে সেখানে কোনো মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনেও অংশ নেয় না এই শহর। তবে? এতদিন কি তবে ভুল হিসাবেই পরিগণিত হয়েছে ব্যাপারটা? বিষয়টা প্রকাশ্যে আসতেই রীতিমতো চমকে গিয়েছিল মেক্সিকো সরকার। অবাক হয়েছিলেন খোদ রিও রিকোর বাসিন্দারাও। তাঁরা ইংরাজিভাষী হলেও, এতদিন নিজেদের মেক্সিকান বলেই পরিচয় দিয়ে এসেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন তাবড় সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নেয় এই খবর। রিও রিকোর পিঠে জোটে ‘ফরগটেন আমেরিকান সিটি’-র তকমা। কিন্তু এত বড়ো ভুলের কারণ কী?

আসলে এই সমস্যার ইতিহাস জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১৭৫ বছর আগে। ১৮৪৮ সালে রিও গ্রান্ডে নদীকেই নিজেদের দেশের সীমান্ত ঘোষণা করেছিল মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্র— দুই দেশের সরকারই। এই নদীর উত্তর প্রান্তের অঞ্চল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত, অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চল মেক্সিকোর। আর সেখান থেকেই জন্ম এই বিতর্কের। আজকের দিনে দেখতে গেলে রিও রিকো শহরটি রিও গ্রান্ডে নদীর দক্ষিণেই অবস্থিত। কাজেই তা মেক্সিকোর অধীনেই থাকার কথা। আর সে-কারণেই এই শহরের বাসিন্দারা নিজেদের পরিচয় দেন মেক্সিকান হিসাবে। 

তবে আজ এই অঞ্চলের যা ভূ-প্রাকৃতিক গঠন, আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে তেমনটা ছিল না মোটেই। বরং, রিও গ্রান্ডে অবস্থিত ছিল রিও গ্রান্ডের উত্তরেই। ঘেঁটে গেলেন নিশ্চয়ই? ব্যাপারটা খুলে বলা যাক একটু। 

অশ্বখুরাকৃতি হ্রদের কথা জানা সকলেরই। নদীর গতিপথ সর্পিল হলে, নিকটবর্তী দুটি বাঁকের মধ্যবর্তী জমি ক্ষয়ে গিয়েই তৈরি হয় নতুন গতিপথ। অন্যদিকে বাঁকা, সর্পিল অংশটি মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিণত হয় হ্রদে। ১৮৪৮ সালে তৈরি ম্যাপ থেকে পরিষ্কার হয় রিও রিকোর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল এই একই ঘটনা। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোটা প্রাকৃতিক পরিবর্তন ছিল না মোটেই।

উনিশ শতকের শেষের দিক সেটা। রিও গ্রান্ডে শহরের বুকে নির্মিত হয় একটি ইরিগেশন পাম্পিং স্টেশন। সেচের জন্য নদীর জল পাম্পের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হত এই স্টেশনের মাধ্যমে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায়, কৃত্রিমভাবে খাল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। নদীর দুটি বাঁকের মধ্যবর্তী জমিতে সরু খাল কেটে সংযুক্ত করা হয় পাম্পিং স্টেশনের সঙ্গে। যাতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের হলেও পাম্পিং স্টেশন সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন না পড়ে। 

পাম্পিং সংস্থাটির এই সিদ্ধান্তই শেষে শাপ হয়ে দাঁড়ায় রিও রিকোর জন্য। প্রাকৃতিক নিয়মেই ক্রমে বাড়তে থেকে খালটির আয়তন। এমনকি কয়েক বছরের মধ্যে সেটিই হয়ে ওঠে নদীর মূল গতিপথ। পরিত্যক্ত হয় বাঁকানো অংশটি। সেটি পরিণত হয় অশ্বখুরাকৃতি হ্রদে। যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত রিসাকা নামে। অন্যদিকে রিও রিকো নদীর দক্ষিণে চলে যাওয়ায় ক্রমে ক্রমে তা হয়ে ওঠে মেক্সিকোর অংশ। 

অবশ্য রিও রিকোর বাসিন্দাদের সংস্কৃতি এবং জীবনযাপনে পরিবর্তন এলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি কখনোই। বরং, এই শহরই হয়ে উঠেছিল মাদক পাচারের কেন্দ্র। ১৯২০ সালে যখন গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নিষিদ্ধ হয় অ্যালকোহল, তখন বহু মার্কিনিই সাঁতরে বা নৌকা করে চলে আসতেন নদীর এ-পাড়ে। রিও রিকো থেকে বেশি মূল্য দিয়ে সংগ্রহ করতেন সুরা। আর সেই টাকাতেই ফুলেফেঁপে ওঠে ছোট্ট শহরটি। তাছাড়াও অন্যান্য মাদক পাচারের ক্ষেত্রেও এই শহরের দুর্নাম ছিলই। 

১৯৬৭ সালে একটি সমীক্ষার সময়ই উঠে আসে, এই শহর আদতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ। আর তারপরই আনুষ্ঠানিকভাবে মেক্সিকো প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আবেদন জানায় মার্কিন প্রশাসন। হ্যাঁ, শেষ অবধি তাতে রাজি হয়ে যায় মেক্সিকো। যুদ্ধ-রক্তপাত ছাড়াই এই শহর ফের জায়গা পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পৃথিবীর ইতিহাসে এহেন দ্বিতীয় কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা সন্দেহ রয়েছে তা নিয়ে…

Powered by Froala Editor

Latest News See More