মারাদোনা ছুটছেন। নীল গোলকের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সারা বিশ্ব দেখছে। কেউ বলছেন চলমান বিপ্লব। কেউ আবার বলে দিচ্ছেন মারাদোনার দৌড়টা মেক্সিকোতে শুরু হলেও শেষটা হয়েছিল কখনো শ্যামবাজারের আড্ডায়, কখনো বার্লিনের দেওয়ালে, কখনো সিরিয়ার সেনাঘাঁটিতে কিংবা সে এখনো শেষই হয়নি, কেবল ছুটেই চলেছেন তিনি। অথচ মারাদোনা এসব কিছু ভাবছেন না। পায়ের জাদুতে সাদা বলটার গায়ে দুটো বিপ্লবের ডানা লাগিয়ে দিচ্ছেন মারাদোনা, সে উড়ে যাবে, সবুজ মাঠ পেরিয়ে সমাজ এবং একটা বৃহত্তর সমাজে সে অবাধে বিচরণ করতে পারবে কখনো বিপ্লবে, কখনো বিদ্রোহে, প্রেমে কিংবা বিচ্ছেদে...
সাদাকালো টিভি। খসখসে শব্দ। শুধু কয়েকটা এলোমেলো শব্দ জুড়ে দিলে একটা সম্মিলিত চিৎকার ভেসে আসছে- দিয়েগো, দিয়েগো!
একটা বেঁটে শক্তপোক্ত লোক ছুটছে, কেউ আটকাতে পারছে না তাকে। সে দৌড়টা এক মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে। সে পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে - যেভাবে বিপ্লব আসে, আজ সেভাবেই যেন কবিতাও আসছে পৃথিবীতে। মারাদোনা দুটো পৃথিবীকে মিলিয়ে দিচ্ছেন নিজের অজান্তেই। একটা একটা ফুটবল রোম্যান্টিসিজমের পৃথিবী, অন্যটা ক্ষতবিক্ষত একটা জাতির ঘন বাদামবনের ভেতর লালপতাকা হাতে ছুটে আসা তরুণের পৃথিবী...
আর্জেন্টিনা। একটা ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি, বছরের পর বছর একই রকম দারিদ্র্য , ধনতন্ত্রের কাছে শোষিত হাজার হাজার মানুষ, দীর্ঘদিনের দেনায় জর্জরিত একটা দেশ - তবু ঐ যে-বিপ্লবের দেশ - হদ্দ বোকার মতোই খালি পেটেই সে বিপ্লব করবে। বিশ্বের পুঁজিবাদী সিস্টেমের বিরুদ্ধে ক্ষীণ স্বর তোলার যে অদম্য জেদ তা আর্জেন্টাইন রক্তে মিশে গিয়েছিল ১৯৩৪ সাল থেকেই। ফুটবল আর এই দেশটার সম্পর্ক অনেকটা 'বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি'-র মতো। নিখাদ।
১৯৩৮ সালে বিশ্বকাপ বয়কট করল আর্জেন্টিনা। সেবার ইতালির স্বৈরাচারী শাসক বেনিত্তো মুসোলিনি নিজের ক্ষমতাবলে বিশ্বকাপ করালেন। কার্যত গা জোয়ারি করে, রেফারিকে চাপ দিয়ে নিজের ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রয়োগ করে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে দিলেন ইতালিকে। কোয়ার্টারে রেফারিকে হুমকি দিয়েও যখন স্পেনকে হারানো সম্ভব হচ্ছে না তখন মুসোলিনি ভয় দেখিয়ে ৭ জন স্প্যানিশ খেলোয়াড়কে মাঠেই নামতে দিলেন না। ফুটবল খেলাটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেদিন থেকেই ফ্যাসিস্ট রাজনীতি মিশে যাচ্ছিল। সারা বিশ্ব দেখল কিন্তু পরাক্রমী মুসোলিনির বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেল না কেউ। একটাই দেশ এই গোটা মৌন পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়ে মুসোলিনির বিরুদ্ধে সরব হল। তার না আছে সামরিক শক্তি, না আছে অর্থের প্রাচুর্য, না আছে ক্ষমতার আস্ফালন- আছে শুধু ফুটবল। উদবোধনী বিশ্বকাপের রানার্স হয়েও তিনটে বিশ্বকাপ বয়কট করে দিল আর্জেন্টিনা। ১৯৩৮-এ ফ্রান্স, ১৯৫০-এ ব্রাজিল এবং ১৯৫৪ তে সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে খেলল না তারা। ১৯৩৯-এ মাঠে প্রকাশ্যে নির্মম লাঠিচার্জ করা হল আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের ওপর। গ্যালারিজুড়ে নীলসাদা দর্শক গেয়ে উঠল গান। ফিফার সুনজরে ইউরোপিয়ান দেশগুলো আর ব্রাজিল থাকলেও কোনোদিনই এই তালিকায় নিজেদের দেখতে চায়নি আর্জেন্টিনা। হয়তো বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও আর্জেন্টিনায় বরাবর অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ফুটবলের উঠে আসাটা।
এই জায়গাতেই একটা ঝড়ের মতো এসেছিলেন মারাদোনা। ১৯৫৪ অবধি পরোক্ষ শত্রুতা থাকলেও ১৯৬৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামে তৃতীয় বিশ্বের দেশটা। কোয়ার্টার ফাইনালে রেফারির পক্ষপাতিত্বের সুযোগে জিতে গেল ইংল্যান্ড। আর্জেন্টিনার রাস্তায় পোস্টার পড়ল - 'এল রোবো দেল সিগলো...', শতাব্দীর সেরা চুরি। তবে মারাদোনার উত্থানের প্রেক্ষাপটটা এঁকে দিয়েছিল ফকল্যান্ড ওয়ার। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ছিল ইংল্যান্ডের মাটি থেকে ৮ হাজার ৭৮ মাইল দূরে। আর আর্জেন্টিনা থেকে মাত্র ৩০০ মাইল দূরে। তবু ইংল্যান্ডের জোর করে এই দ্বীপ অধিগ্রহণ নিয়ে একটা রাজনৈতিক তরজার দামামা বেজে ওঠে। ব্রিটেন সেনা পাঠিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল। আর্জেন্টিনা অসহায়, চোখের সামনে রক্তস্রোতে ভেসে গেল ৬৫০ তরতাজা প্রাণ। সারাবিশ্বে তখন থেকেই আর্জেন্টিনা একটা নরম যন্ত্রণা, পাহাড়ের বুকে ফুটে থাকা রডোডেনড্রনের মতো লাল ব্যথা - আর ১৯৮২ সালের এই ঘটনার পর আর্জেন্টিনা পাগলের মতো খুঁজছিল একজন নায়ক - এই সময়েই যেন ঈশ্বর এলেন ফুটবলে!
১৯৮৬-তে এই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই মারাদোনা নামবেন। একটা ঝাঁকড়া চুলের ছেলে। সারা বিশ্ব বুঝতে পারছে লোকটা সাধারণ কেউ নন। এর আগে জনমানসে এই প্রভাব একজনেরই ছিল, তিনি ফুটবল সম্রাট পেলে। কিন্তু তাঁকে তো চোখে দেখেনি বিশ্ব - এই ছেলেটাকে দেখছে। কাগজের পাতা থেকে একেবারে ময়দানে নেমে এসেছে বিপ্লব - কোমরের ভাঁজে ছিটকে দিচ্ছে সব প্রতিপক্ষকে, বাঁ পায়ে যেন ছুরির ফলার মতো ধার - তৃতীয় বিশ্ব পেয়ে গেল তাদের সুপারস্টারকে। লোকটা বুকের দুপাশে নিয়ে ঘুরছেন ফিদেল কাস্ত্রো আর চে গুয়েভারা। আর্জেন্টিনার ওপর সমস্ত অত্যাচারের বদলা নিতে পায়ে তুলে নিচ্ছেন ফুটবল। তবে এই নায়কোচিত উত্থান কিন্তু ছিয়াশির আগেই ঘটে গেছে। ইতালির অন্ধকার শহর নাপোলিতে তাঁকে আনা হয়েছিল ব্যর্থতা থেকে চোখ ঘোরানোর জন্য, সমাজের অজস্র ক্ষইতে থাকা মূল্যবোধকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। আর মারাদোনা সেই অন্ধকার নাপোলিকে একাই নিয়ে এলেন সাফল্য সরণীতে। যাই হোক, ফেরা যাক।
মারাদোনা হাত দিয়ে গোল করে চলে গেলেন, ইংল্যান্ড ফুঁসছে ক্ষোভে, রেফারি আর লাইন্সম্যান বাদে সারা বিশ্ব দেখল ঘটনাটা, কিন্তু তার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেল সব্বাই। মারাদোনা যেন ধর্মের উর্দ্ধে উঠে সেই ধর্মযাজক, সতীর্থ যখন গোলের পর বুঝতে পারছেন না বিষয়টা, মারাদোনা আলতো হেসে অবলীলায় বলে দিচ্ছেন এটা ঈশ্বরের হাত...
আর এই ভিলেন থেকে ঈশ্বর হয়ে ওঠার পথটা মারাদোনাই লিখলেন। কয়েক মিনিট পর। গোল অফ দ্যা সেঞ্চুরি - ব্রিটেনের ঔদ্ধত্য আর বিশ্বের পুঁজিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটা জোরালো প্রতিবাদ। খেলার আগে মারাদোনা সতীর্থদের ডেকে বললেন- 'আমাদের বুকে স্বজন হারানোর দগদগে ঘা এখনো শুকোয়নি, আমাদের অর্থ নেই, অস্ত্র নেই, আছে শুধু ফুটবল - তাই এই ম্যাচটাই আমাদের প্রতিবাদের মঞ্চ।'
ইংল্যান্ডের ১৯৬৬, ১৯৮২ সহ প্রায় তিন দশকের আঘাত মারাদোনা একটা দৌড়ে মিটিয়ে দিলেন। যার খেলার শুরুটা হয়েছিল স্প্যানিশ কলোনির সেই কাঁকড়েভরা মাঠে, খালি পায়ে - সেই ছেলেটাই আর্জেন্টিনার অপুষ্টিতে ভোগা, অনাহারে থাকা মানুষদের জন্য রেখে গেলেন একটা ব্রহ্মাস্ত্র, বিপ্লবের একটা শেষ ইশতেহার...
কাল একজন লিখেছিলেন নস্ট্যালজিয়ার কথা, লিখেছিলেন- 'মারাদোনা একা মরল না। একটা আস্ত সময়কে নিয়ে মরে গেল।' আর আমার বারে বারে মনে হচ্ছে মারাদোনা যেন মারাই যাননি, শুধু সযত্নে একটা বিপ্লবের প্যামফ্লেটকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়ে দুহাত মেলে শুয়ে পড়লেন সবুজ ঘাসে, নিজস্ব, একেবারে নিজস্ব সাম্রাজ্যে....
Powered by Froala Editor