প্রতিটা মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু তার থেকেও বেশি। অজস্র সম্ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় তখন। এদেশে মহিলাদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে তেমনই এক উজ্জ্বল মুখ ছিলেন দেবশ্রী চ্যাটার্জি। কিন্তু একেবারেই আকস্মিক দুর্ঘটনায় শুক্রবার ভোররাতে মৃত্যু হল তাঁর। শেষ হল কলকাতা পুলিশের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।
দেবশ্রী চ্যাটার্জির নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। তার কারণ তিনি কলকাতা পুলিশ বিভাগের প্রথম মহিলা অফিসার-ইন-চার্জ ছিলেন। কিন্তু এটুকুই তাঁর সামগ্রিক পরিচয় নয়। দেবশ্রী চ্যাটার্জি একটা টিকে থাকার লড়াইয়ের নাম। পুলিশের জগতে যেখানে সব দিকেই পুরুষের আধিপত্য, সেখানে একজন নারীর নিজেকে প্রমাণ করার লড়াইয়ের নাম দেবশ্রী চ্যাটার্জি। এই লড়াইটা শুরু হয়েছিল ১৯৮৮ সালেই। যখন তিনি পুলিশ অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং-এর জন্য গেলেন। ১৯৯০ সালে বাহিনীতে যোগ দিলেন সাব-ইনস্পেক্টর হিসাবে। সেটাও তখন পুলিশ বিভাগের মধ্যে বেশ অবাক করা ঘটনাই ছিল।
তবে নিজেকে কোনো ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখেননি দেবশ্রী চ্যাটার্জি। পাল্লা দিয়ে সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছেন। আর তাই ২০১০ সালে নর্থ পোর্ট থানায় অফিসার-ইন-চার্জ হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি। এ রাজ্যে ইতিপূর্বে কোনো মহিলা এই দায়িত্ব পাননি। তবে থানার সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পরেও প্রতিবন্ধকতা পিছনে সরে যায়নি। ২০১২ সালে তাঁর জায়গায় বহাল হন কিশোর শর্মা নামের এক অফিসার। দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পরেই তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অফিসার দেবশ্রী চ্যাটার্জির নামে কুৎসিত মন্তব্য প্রকাশ করতে থাকেন। আর তার কারণ দেবশ্রী একজন মহিলা। আসলে দেশের সামগ্রিক চেহারাই যে মহিলাদের জন্য নিরাপদ নয়। পুলিশ বিভাগেও সেই একই ছবি ফুটে উঠেছিল।
দেবশ্রী চ্যাটার্জির হেনস্থার ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেছিল প্রশাসন। যে বিভাগে মহিলা পুলিশরাই সম্মান পান না, সেই বাহিনী রাজ্যের সমস্ত মহিলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কীভাবে? উঠেছিল এই প্রশ্নও। সম্ভবত ২০১২ সালেই একের পর এক মহিলা থানা গড়ে তোলার পিছনে মূল কারণ ছিল এই বিতর্কই। আর সেই সময় যে কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ বিভাগের সমস্ত মহিলা কর্মীদের উপরেই হঠাৎ অনেকটা কাজের দায়িত্ব এসে পড়েছিল, সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রত্যেককে সেই পরীক্ষার জন্য গড়ে তোলার দায়িত্ব যেন একাই নিয়ে নিয়েছিলেন দেবশ্রী চ্যাটার্জি। এই পরীক্ষা আসলে তাঁরই পরীক্ষা ছিল। আর তিনি সফল হয়েছেন বলেই ক্রমশ রাজ্যে মহিলা থানার গুরুত্ব বেড়ে চলেছে।
আরও পড়ুন
পুরুষদের মতো মহিলা ফুটবলাররাও পাবেন সমপরিমাণ বেতন, যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ব্রাজিলের
কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার পদেও ছিলেন দেবশ্রী চ্যাটার্জি। এই সময় থেকেই মানব পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায় তাঁকে। তিনি এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবেও পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। পরে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন এলে তাঁকে কলকাতা পুলিশ থেকে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়। মাত্র একমাস হল তিনি শিলিগুড়ির ফুলবাড়ি দ্বাদশ ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এর মধ্যেই সেখানে মানব পাচার রুখতে নানারকম পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন। বাহিনীর সকলকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটা পরিবার। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথেই হুগলির দাদপুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর একটি ট্রাকে ধাক্কা মারে দেবশ্রীর গাড়ি। ঘটনাস্থলেই দেবশ্রী সহ তাঁর ড্রাইভার এবং দেহরক্ষী প্রাণ হারান। দেবশ্রী চ্যাটার্জির মৃত্যুতে তাঁর নিজের পরিবার যেমন শোকস্তব্ধ, তেমনই শোকস্তব্ধ কলকাতা পুলিশ বিভাগও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ট্যুইট বার্তায় জানিয়েছেন, তাঁর মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। আর অবশ্যই আপনজন হারানোর বেদনা অনুভব করছেন রাজ্যের অসংখ্য মহিলা পুলিশকর্মী। দেবশ্রী বেঁচে না থাকলেও সেই লড়াই থেকে যাবে। হয়তো সত্যিই কোনোদিন পুরুষ কর্মচারীদের পাশাপাশি সমানাধিকার পাবেন মহিলারাও।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দেশের রোজগেরে মহিলাদের ৮৩ শতাংশই ঠিকা শ্রমিক; অস্বাভাবিক কম পারিশ্রমিকে দিন গুজরান