আকাশের বুকে মেঘেদের পাশ দিয়ে উড়ে চলেছে ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান। ককপিটে বসে মেরুদণ্ড শক্ত করে নিলেন পাইলট। এবার একটু ভিতরে চোখ নিয়ে গেলেই অবাক হতে হয়। পাইলটের আসনে যে মানুষটি বসে আছেন, তাঁর চেহারা আমাদের অতি পরিচিতি ‘টল অ্যান্ড হ্যান্ডসাম’ নয়। আসলে তিনি কোনো পুরুষ নন। মহিলা হয়েই বায়ুসেনার বিমানে চড়ার যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছেন তিনি। তাও ভারতের মতো একটা দেশে, যেখানে আজও অধিকাংশ মেয়ের জীবন বন্দি করে ফেলা হয় সংসারের চার দেয়ালে। আকাশের বুকে যেন সমস্ত মহিলার মুক্তির ইচ্ছাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন পদ্মাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতের সেনাবাহিনীতে প্রথম মহিলা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট পুনিতা অরোরা। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ১৯৬৮ সালে যোগ দিলেন তিনি। তখন অবশ্য পদ্মাবতী স্বামীনাথন। পদ্মাবতী যোগ দিলেন বায়ুসেনায়। আর বিমান বাহিনীর প্রথম মহিলা মার্শাল তিনিই। পুনিতা অরোরার মতোই তিনিও তিনটি তারকা পদকের অধিকারী। সত্যিই এক বিচিত্র জীবন পদ্মাবতীর। আর সেই জীবনের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে গিয়েছেন তাঁর স্বামী সতীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। একই বছর বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন দুজনেই। সেখানেই পরিচয়। জীবনসঙ্গীকে চিনে নিতে বেশি দেরি হয়নি। আর তারপর বাকি জীবন কেটেছে আকাশের বুকে, অনিশ্চয়তার মেঘের মধ্যে দিয়ে।
১৯৭২ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের আসর। সেনাবাহিনীর বিশেষ কিছু ফৌজিকে নিজের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন রাষ্ট্রপতি। আর সেই মঞ্চে একসঙ্গে এগিয়ে এলেন এস. এন. বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পদ্মাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক তার আগের বছরই শুরু হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ। বাংলাদেশকে ঘিরে বিরোধ তো তখনও চলছেই। সেই যুদ্ধে পদ্মাবতীর সাহসিকতার সম্মান হিসাবে পেলেন বিশিষ্ট সেবা মেডেল। বায়ুসেনার বিশেষ ইউনিফর্মে যোগ হল আরও একটি তারকা। তবে পথচলার তো তখন তবে শুরু। নিজের সমস্ত উজাড় করে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে যে। প্রমাণ করতে হবে যে ভারতীয় মহিলারাও পারে। শুধু উপযুক্ত সুযোগের অভাব।
১৯৮৯ সালে ভারতের বায়ুসেনা থেকে প্রতিনিধি হিসাবে উত্তর মেরু অভিযানে গেলেন পদ্মাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়। মেরু ভল্লুকের দেশে পা পড়ল এক ভারতীয় মহিলার। ৩ মাস সেখানে ক্যাম্প করে থেকেও গেলেন। তারপর ফিরে এসে আবার আকাশের বুকে। যুদ্ধের ময়দান থেকে একটু দূরে সরে এসে ২০০২ সালে ভাইস-মার্শাল। এরপর ২০০৫ সালে বায়ুসেনার প্রথম মহিলা মার্শাল। উড়ান, উড়ান…
১৯৪৪ সালের ৪ নভেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি শহরে জন্ম পদ্মাবতী স্বামীনাথনের। জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী হলেন মা। চিকিৎসার জন্য নানা শহরে ঘুরতে হয়েছে। আর সবসময় সঙ্গে থেকেছেন পদ্মা। এভাবেই দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে এসে পরিচয় হল এক মহিলা ডাক্তারের সঙ্গে। তাঁর স্নিগ্ধ চেহারা আর রোগীদের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়েছিল ছোট্ট পদ্মা। আর আরও অবাক হয়েছিল, যখন জেনেছিল সেই ডাক্তারের নামও পদ্মাবতী। সেদিনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে হবে।
ডাক্তার হওয়ার লক্ষ নিয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন পদ্মাবতী। আর সেই সূত্রেই দিল্লির কিরোরি মাল কলেজে ভর্তি হলেন প্রি-মেডিক্যাল কলেজে। তারপর সেখানে পরীক্ষার ফল ভালো হওয়ায় সুযোগ এল আর্মড ফোর্স মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার। আর সেখানেই ঘটে গেল জীবনের এক অভাবনীয় পরিবর্তন। ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন পদ্মাবতী। ডাক্তার হলেন। তবে সেনাবাহিনীর ডাক্তার। আর সেখান থেকেই সোজা যুদ্ধের ময়দানে। ভাগ্যিস এভাবে বদলে গিয়ছিল জীবনের চলার পথ। তাই তো তিনটি সেবা মেডেল, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী পুরস্কার এবং পদ্মশ্রী পুরস্কারে দেশ সম্মান জানাতে পেরেছে তার বায়ুসেনার প্রথম মহিলা মার্শালকে।
তথ্যসূত্রঃ
Limca Book of Records, 2018
Marching Ahead: 13 Incredibly Brave Women in Indian Armed Forces Who Broke the Glass Ceiling, SANCHARI PAL, The Better India
First woman Air Vice Marshal, Times of India, Nov 26, 2002
আরও পড়ুন
প্রয়াত ভারতীয় বায়ুসেনার প্রথম মহিলা কমান্ডার বিজয়লক্ষ্মী রামানন
Powered by Froala Editor