২৫০ বছর আগে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের জন্য কলম ধরেছিলেন এই ক্রীতদাস-কবি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের কমনওয়েলথ অ্যাভিনিউ। এই রাস্তার গা ঘেঁষেই রয়েছে প্রকাণ্ড একটি পার্ক। সেখানে হাঁটতে গেলেই চোখে পড়বে ব্রোঞ্জের তৈরি প্রমাণ আকারের কয়েকটি মানবমূর্তি। একটির সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে কবি সুকান্তের। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতোই গালে হাত রেখে হাঁটুমুড়ে বসে রয়েছেন তিনি। বয়সের নিরিখে তিনিও তরুণী। কিন্তু কে এই মহিলা?

ফিলিস হুইটলি (Phillis Wheatley)। বিশ্বের প্রথম মার্কিন-আফ্রিকান মহিলা কবি তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় কৃষ্ণাঙ্গ কবি। শুধু কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যকে দিশা দেখানোই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষাঙ্গ অধিকারের জন্যও আমৃত্যু লড়াই করেছেন ফিলিস। কলমের মাধ্যমেই প্রতিবাদ করেছিলেন দাসত্ব প্রথার (Slavery)। অবশ্য মার্কিনি হলেও, ফিলিসের জন্ম সে-দেশে নয়। সম্ভবত গাম্বিয়া কিংবা সেনেগালেই জন্ম তাঁর। 

এই গল্পের শুরু অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ১৭৬১ সাল সেটা। ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা করেছিল প্রকাণ্ড একটি বাণিজ্যতরী, ‘দ্য ফিলিস’। মূলত ব্রিটেন থেকে প্রকাণ্ড সব চায়ের কন্টেনার বা বাক্স আমেরিকায় পৌঁছে দেওয়ার কাজই করত এই জাহাজ। সঙ্গে চলত আরও একটি গোপন ব্যবসা। ক্রীতদাসের ব্যবসা। আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরী, তরুণী, যুবক-যুবতীদের ‘অপহরণ’ করে নিয়ে এসে চড়া দামে বিক্রি করা হত আমেরিকায়। ‘দ্য ফিলিস’-এর ছবিও ছিল একইরকম। সবমিলিয়ে সেবার ‘দ্য ফিলিস’-এ বন্দি করা হয়েছিল প্রায় ৯০ জন ক্রীতদাসকে। যাদের মধ্যে একজন আমাদের এই গল্পের নায়িকা। কবি ফিলিস হুইটলি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৮ বছর। 

১৭৬১-র ১১ জুলাই বস্টন বন্দরে ভেড়ে ব্রিটেনের ‘দ্য ফিলিস’ জাহাজটি। নতুন শহর, অচেনা মুখের ভিড় চারিদিকে, শ্বেতাঙ্গদের ঘৃণাময় দৃষ্টি, সেইসঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। সবকিছুই যেন ছিল তাঁর প্রতিকূলেই। আর এই হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেই আলোর রশ্মি হয়ে তাঁর কাছে হাজির হয়েছিলেন এক মার্কিন ধনকুবের জন হুইটলি। বদলে গিয়েছিল ফিলিসের ভাগ্য। 

বস্টন শহর তথা ম্যাসাচুসেটে তখন রীতিমতো নামডাক জনের। শহরের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব তিনি। তাছাড়া প্রগতিশীল মানুষ হিসাবেও যথেষ্ট খ্যাতি ছিল তাঁর। সেদিন স্ত্রী সুজানার জন্মদিনের উপহার কিনতেই বস্টন বন্দরে হাজির হয়েছিলেন জন। এই উপহার আর কিছুই না, নতুন ক্রীতদাস। যে সবসময় পাশে পাশে থাকবে তাঁর স্ত্রীয়ের, সাহায্য করবে ঘরের কাজ-কর্মে। ‘দ্য ফিলিস’-এ পা রাখার পড়েই জনের নজর কেড়েছিল জড়োসড় হয়ে বসে থাকা ৮ বছর বয়সি এক কিশোরী। ঠান্ডায় কাঁপছে শরীর। তার ওপর খানিক মায়া পড়ে গিয়েছিল জনের। শক্তসামর্থ প্রাপ্তবয়স্কদের বদলে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ছোট্ট এই কিশোরীটিকেই কিনে নিয়েছিলেন তিনি। জাহাজের নামেই তার নাম রেখেছিলেন ফিলিস। 

তবে ‘কড়ি দিয়ে কিনলেও’ ফিলিসের সঙ্গে কোনোদিন দাসের মতো ব্যবহার করেননি জন এবং সুসানা। বরং, তাঁদের থেকে সন্তানস্নেহই পেয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ফিলিস। এমনকি জন-সুসানার সন্তান মেরির কাছে রীতিমতো পড়াশোনাও শুরু করেন ফিলিস। ১২ বছর বয়সেই আয়ত্ত করেছিলেন ল্যাটিন এবং গ্রিক ভাষা। পড়তে পারতেন ইংরাজি বাইবেল। 

ছোট্ট কিশোরীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকে চিনতে অসুবিধা হয়নি জনের। বাড়ির ছোটো-খাটো যেটুকু কাজ করতে হত ফিলিসকে, সেখান থেকেও তাকে ছুটি দেন জন। তাঁর সাহিত্য, ইতিহাস, থিওলজি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ হয় বিশেষ গৃহশিক্ষক। এর বছর দেড়েকের মধ্যেই কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ফিলিসের। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বেশ কিছু কাপলেট এবং এলিজি রচনা করেছিলেন কিশোরী ফিলিস। জনের খ্যাতির সুবাদে তা জায়গাও করে নিয়েছিল বস্টনের বেশ কিছু পত্রিকায়। 

ভাষাগত বা সাহিত্য গুণমানের দিক থেকে এই কবিতা সাহিত্য ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারেনি ঠিকই। তবে তাঁর কবিতার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। কখনও তাঁর কবিতাই হয়ে উঠেছিল রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে স্ট্যাম্প অ্যাক্ট বাতিল করার খোলা চিঠি, কখনও আবার ১২ বছর বয়সি কৃতদাসের মৃত্যুর বিরুদ্ধে কবিতার মধ্যে দিয়েই সরব হয়েছিলেন কিশোরী ফিলিস। 

তবে এই সুখময় জীবন স্থায়ী হয়নি খুব বেশিদিন। জনের মৃত্যুর পর ফিলিসের জীবনে শুরু হয় আরও এক প্রতিকূল অধ্যায়। এমনকি তাঁর কবিতা ছাপতে অস্বীকার করে বস্টনের নানান পত্রিকা এবং একাধিক মার্কিন প্রকাশক। পাশাপাশি বস্টনে এও ছড়িয়ে পড়ে যে অন্যের কবিতা চুরি করেই ব্যবসা করছেন ফিলিস। ফলস্বরূপ ১৭৭২ সালে আদালতে তোলা হয় তাঁকে। দীর্ঘক্ষণ জেরা চালান ম্যাসাচুসেটের গভর্নর। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কবিত্বের প্রমাণ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ফিলিস। শেষ অবধি জয় এলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী সমাজ যে জায়গা দেবে না ফিলিসকে, তা ভালোই বুঝেছিলেন সুসানা। আর সেই কারণেই তাঁকে ব্রিটেনের কলেজে পড়তে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

১৭৭৩ সাল। ফের ইংল্যান্ডযাত্রা ফিলিসের। সঙ্গী হয়েছিলেন জনের পুত্রসন্তান নাথানিয়েল। ইংল্যান্ডের হান্টিংটনে এক স্কুলে ভর্তি হন ফিলিস। সে-বছরই হান্টিংটনের কাউন্টেস সেলিনা হেস্টিংসের তত্ত্বাবধানে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই। ছাপার খরচ বহন করেছিল হুইটলি পরিবারই। এমনকি এই বই প্রকাশের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সুসানা ক্রীতদাস ‘তকমা’ থেকে মুক্তিও দেন তাঁকে। পরবর্তী কয়েক বছরে লন্ডনের বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ফিলিস। তাছাড়া তাঁর কবিতা বিশেষভাবে জাগিয়ে তুলেছিল কৃষ্ণাঙ্গদের। শ্বেতাঙ্গ সমাজে গড়ে তুলেছিল সচেতনতা। পরবর্তীতে ১৮৩৩ সালে ব্রিটেনে এবং ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের অবসানের পিছনে যার গুরুত্ব অপরিসীম।

১৭৮৪ সালের ৫ ডিসেম্বর মাত্র ৪০ বছর বয়সে প্রয়াত হন ফিলিস। তবে তাঁর শুরু করা আন্দোলনই পরবর্তীতে তরঙ্গায়িত করে পাশ্চাত্যকে। জীবদ্দশায় সমাদর না পেলেও, বিশ শতকে বিশেষভাবে তাঁকে নিয়ে গবেষণা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাঁর নামে গড়ে তোলা হয় একাধিক স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি। বস্টনের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর মূর্তি। সবমিলিয়ে মৃত্যুর প্রায় আড়াইশো বছর পরেও আফ্রো-আমেরিকানদের স্মৃতিতে আজও বেঁচে রয়েছেন তরুনী কবি ফিলিস হুইটলি…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More