সময়টা ১৯৪৯ সাল। স্বাধীন ভারতের তৃতীয় রঞ্জি ট্রফির ম্যাচে মাঠে নামলেন মহারাষ্ট্রের এক তরুণ ক্রিকেটার। বয়স মাত্র ১৮ বছর। কিন্তু সেটুকুই আশ্চর্যের বিষয় নয়। দর্শকরা জানতে পেরেছেন তরুণ এই ক্রিকেটার কিছুই শুনতে পারেন না। ফলে কথাও বলতে পারেন না একেবারে। শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষদের তখনও করুণার চোখে দেখতেই অভ্যস্ত ভারতীয়রা। কিন্তু সবাইকে অবাক করল ছেলেটির খেলা। যেমন ব্যাট হাতে, তেমনই ফিল্ডিং-এ। মাঠে যেন বাজপাখির মতো দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটি। তার হাত ফসকে বাউন্ডারি পেরনোর উপায় নেই বলের। এভাবেই ভারতীয় ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ বাবা সিন্ধের (Baba Sindaye)। তিনিই দেশের প্রথম মূক ও বধির ক্রিকেটার।
১৯৩২ সালে ইরানের আহবাজ শহরে জন্ম যশবন্ত প্রভাকরের। তাঁর বাবা ছিলেন ইরানের এক নামকরা বাণিজ্যিক সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার। চার ভাই-বোনের মধ্যে যশবন্ত কনিষ্ঠতম। কিন্তু তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই দুঃসংবাদ পেলেন বাবা-মা। এই ছেলের কানে শোনার ক্ষমতা নেই একেবারেই। ফলে কোনোদিন কথা বলতেও শিখবে না সে। প্রভাকর পরিবার তখনই পুনে শহরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তত নিজের দেশে ছেলেকে উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া সহজ হবে। তবে ভারতেও তখন প্রতিবন্ধী শিশুদের বাঁকা চোখেই দেখা হত। স্কুলের বন্ধুরাও বরাবর এড়িয়ে চলত যশবন্তকে। তাই পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলোর দিকেই তার বেশি আগ্রহ দেখা যায়।
মাত্র ৫ বছর বয়সে ক্রিকেটে হাতেখড়ি যশবন্ত প্রভাকরের। তিনিই পরে বাবা সিন্ধে নামে পরিচিত হয়ে উঠবেন। ছোটোবেলায় ক্রিকেট ছাড়াও খোখো, কুস্তির মতো নানা খেলায় মেতে থাকতেন তিনি। এই সময়েই একদিন তাঁর ক্রিকেট খেলা চোখে পড়ে নামকরা টেস্ট ক্রিকেটার সদাশিবরাও গণপত সিন্ধের। কিন্তু যখন তিনি শুনলেন যে যশবন্ত ক্রিকেট ছাড়া আরও নানা খেলাতেই পারদর্শী, তখন কিছুটা হতাশই হয়েছিলেন। তবুও ডেকে পাঠালেন কিশোর যশবন্তকে। বললেন, সমস্ত খেলার মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। বিন্দুমাত্র ভাবনাচিন্তা না করেই সেদিন ক্রিকেট খেলাটিকে বেছে নিয়েছিলেন যশবন্ত।
প্রথাগতভাবে ক্রিকেট খেলার সেই শুরু। তারপর বছরখানেকের প্রশিক্ষণের পরেই সোজা রঞ্জির মাঠে। ১৯৪৯ সাল। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি যশবন্তকে। না, আর যশবন্ত নয়। এবার তাঁকে সবাই বাবা সিন্ধে নামেই চিনবেন। মহারাষ্ট্রের হয়ে ৪২টি রঞ্জি টুর্নামেন্টে খেলেছেন বাবা সিন্ধে। সেইসঙ্গে মুম্বাই ডিভিশন এবং রেলওয়ে টিমের হলেও খেলেছেন বহু ম্যাচ। মোট ৫১টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে বাবা সিন্ধের মোট সংগ্রহ ১৮৬২ রান। সাধারণত বল হাতে নামতেন না তিনি। তবুও ক্রিকেট জীবনে ১০টি উইকেটও নিয়েছেন তিনি। আর বাবা সিন্ধে ফিল্ডিং-এ থাকলে প্রতিপক্ষের কাছে নির্ঘাৎ ত্রাস হয়ে উঠতেন। তাঁর ফিল্ডিং-এর ক্ষিপ্রতার জন্য অনেকেই তাঁকে ‘প্যান্থার’ নামে ডাকতে শুরু করেন।
বাবা সিন্ধের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কোনোদিন তাঁর ক্রিকেট জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এমনকি দলের বাকি সদস্যরাও সেই কথা যেন মাথাতেই রাখতেন না। এমনই সহজ, স্বাভাবিক ছিল তাঁর খেলা। শোনা যায় একবার নাকি মেরিন লাইনসের পিজি হিন্দু জিমখানার মাঠে তিনি এমন এক ওভার বাউন্ডারি মেরেছিলেন, বলটি সোজা গিয়ে পড়েছিল আরব সাগরের জলে। প্রায় ২০ বছর মাঠে নেমে ক্রিকেট খেলেছেন বাবা সিন্ধে। এর মধ্যে শেষ দুই বছরে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের অতিথি দলের বিরুদ্ধেও মাঠে নেমেছেন তিনি। নিজে কোনোদিন জাতীয় দলে খেলেননি। কিন্তু ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী জাতীয় দলের খেলোয়াড় বলবীন্দর সিং ছিলেন তাঁরই ছাত্র।
খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর বহু তরুণ ক্রিকেটারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বাবা সিন্ধে। এমনকি তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দিতে চাইতেন না তিনি। প্রত্যেকেই যে ক্রিকেটের মাঠে সমান যোগ্য, এটাই বারবার প্রমাণ করতে চেয়েছেন তিনি। তবে প্রথম সারির ম্যাচের সময় যে নানাধরনের বাধা তৈরি হয়, সেটা স্বীকার করতেন। আর তাই প্রতিবন্ধকতাযুক্ত খেলোয়াড়দের নিয়ে পৃথক জাতীয় দল গড়ে তোলার পিছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ২০০২ সালে ইংল্যান্ডে খেলতে যায় ভারতের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত জাতীয় দল। সেই দলেও ৪ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বাবা সিন্ধে। সেই বছরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাবা সিন্ধে।
সারাজীবনে নানা সম্মান পেয়েছেন তিনি। লিমকা বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম উঠেছে তাঁর। তেমনই বিশ্ব মানবাধিকার সুরক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মান। আর তার চেয়েও বেশি করে পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। কিন্তু এতদিন পর আর কতজনই বা মনে রেখেছেন তাঁকে? বলিউডের সুপারহিট ‘ইকবাল’ সিনেমাটি দেখার সময়েই বা কতজনের মনে পড়েছে? ভারতের মাটিতে একদিন সত্যিই দাপিয়ে বেড়াতেন বাস্তবের ইকবাল বাবা সিন্ধে।
তথ্যসূত্রঃ
১. Baba 'Panther' Sidhaye - The unacknowledged inspiration for Iqbal and very first deaf and mute cricketer, Sportskeeda
২. THE REAL ‘IQBAL’ STORY OF CRICKETER BABA PANTHER SINDHAYE, Poulomi Kundu, Sportsavour
৩. 51 Matches & 1862 Runs: The Inspiring Life of India’s First Deaf & Mute Cricketer, Gopi Karelia, Better India
Powered by Froala Editor