কলকাতা এক মস্ত বড়ো স্মৃতির শহর। তার প্রতিটা বাঁকে যেন জুড়ে আছে পুরনো দিনের গল্প। ঠিক পাশেই হয়ত দাঁড়িয়ে আছে বহুতল। বর্তমান আর ইতিহাসের এমন সহাবস্থান ভারতের নানা জায়গাতেই দেখা যায়। ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’— কথাটা যে কতটা খাঁটি সেটা অন্তত সংস্কৃতি আর ইতিহাসের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে উঠে আসে। যাই হোক, কলকাতার যে পুরনো গন্ধটা নিতে দিনেদুপুরে বেরিয়ে পড়েন অনেকে, সব কি আর আস্ত রয়েছে? আজকের গল্পে বরং একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। এখানের মূল চরিত্র এখনও দাঁড়িয়ে আছে বটে; কিন্তু সে যেন থেকেও নেই!
রাস্তার নাম ২২ ব্ল্যাকবার্ন রোড। নাম শুনলে মনে হবে বিদেশে এসে গেছেন, কিন্তু একেবারে খাস কলকাতারই অংশ হয়ে আছে এটি। এই ঠিকানাতে গেলে দেখতে পাবেন একটি লাল রঙের দোতলা বাড়ি। অবশ্য তার আগে বলে নেওয়া ভালো, আমরা এসে গেছি টেরিটিবাজার এলাকায়। কলকাতার প্রথম চিনে মহল্লা। চারিদিকে চিনা ভাষায় লেখা হোর্ডিং, দোকান। সেইসঙ্গে আছে নানা উপাদেয় খাবার। চিনারা যবে থেকে ভারতে আসে, তবে থেকে সেই দেশের সংস্কৃতির একটা টুকরোও চলে আসে এখানে। সেখানে জড়িয়ে আছে খাবারও। ব্ল্যাকবার্ন রোডের এই লাল দোতলা বাড়িতেই একটা সময় ছিল এমনই একটি রেস্তোরাঁ। যেখান থেকে শহরে খাবারের চিনে-যাত্রা শুরু হয়েছিল। নানকিং রেস্তোরাঁ কলকাতার ফেলে আসা ইতিহাসেরই এক অংশ…
লাল বাড়ির প্রবেশের দরজার ওপরেই সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর লাল কালিতে লেখা ‘তুং-অন চার্চ’। আদতে চিনা মন্দির এটি। এই বাড়িটিরই একতলায় একটা সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নানকিং রেস্তোরাঁ। ১৯২৪-২৫ সালে কলকাতার চিনেপট্টির আউ পরিবারের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা। শোনা যায়, খদ্দেরদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দরজার সামনে থাকতেন বেহালাবাদকেরা। ভেতরে ঢুকলেই অন্য এক জগত। আর চিনে খাবার বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি, তা এখানে পরিবেশন করা হত না। স্রেফ নুডলস আর চিলি চিকেন নয়; হরেক রকম চিনে খাবারের আয়োজন থাকত এখানে।
কলকাতার প্রথম তো বটেই, অনেকের মতে ভারতেরও প্রথম চাইনিজ রেস্তোরাঁ ছিল এটি। ভারতের ছিল কিনা তা নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে; তবে নানকিং-এর ঐতিহ্য নিয়ে কারোর মনে কোনো প্রশ্ন নেই। এত জায়গা থাকতে একটা মন্দিরের নিচে কেন খোলা হল নানকিং, তা নিয়েও অনেক মতামত। তবে এর পেছনে কলকাতার চিনে সংস্কৃতির একটা দিক জড়িয়ে আছে বলে মনে করা হয়। ভারত এবং সর্বোপরি কলকাতায় আসার পর চিনেরা বেশ কিছু নেটিভ প্লেস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয়। এই এক একটা জায়গার নিয়ন্ত্রক থাকে একটি করে মন্দির। তেমনই একটি মন্দিরের নিচেই সুবিধার জন্য তৈরি হয় নানকিং।
আরও পড়ুন
এক বাসে সরাসরি কলকাতা থেকে লন্ডন, ৫০ বছর আগে পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুট ছিল এটিই
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নানকিং রেস্তোরাঁর নাম বাড়তে শুরু করে। একটা সময় শুধু কলকাতা নয়, সারা ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে যায় এটি। শোনা যায়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে খেতে আসতেন। সেইসঙ্গে প্রায় নিয়মিত আসতেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। উত্তমকুমার, সুপ্রিয়াদেবী-সহ টলিপাড়ার অনেকেরই পা পড়েছে এখানে। শুধু বাংলা নয়, একটা সময় রাজ কাপুর, নার্গিস, দিলীপ কুমারের মতো স্টাররাও এখানে এসেছেন। এখানকার বয়স্ক নাগরিকদের জিজ্ঞেস করলে এখনও শোনা যাবে স্মৃতিচারণ। লাল বাড়িটার দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়েছিলেন রাজ কাপুররা।
আরও পড়ুন
কলকাতার ‘দেবতা’ হয়ে উঠেছিলেন এই চিনা ব্যক্তি, টেরিটিবাজারে আজও রয়েছে মন্দির
কিন্তু সময় সবার একরকম থাকে না। ১৯৬২-এর ভারত চিন যুদ্ধের পর থেকে আরও অনেক কিছুর মতো নানকিংয়েরও জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। কলকাতার ইতিহাসের একটা অংশকে যে প্রতিষ্ঠান ধরে রেখেছিল তার অবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। শেষ পর্যন্ত সত্তরের দশকের একদম শেষে এসে দেহ রাখে নানকিং রেস্তোরাঁ। বন্ধ হয়ে যায় ইতিহাসের পথচলা। তবে মন্দিরটি ঠেকে যায়, যা রয়েছে আজও। ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ সিনেমার মাধ্যমে একটু প্রাণ ফিরে পেয়েছিল নানকিং। দেখতে পেয়েছিল নিজের পুরনো রূপ। যে সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত। এভাবেই হয়ত থেমে যায় ইতিহাস। রয়ে যায় শুধু গল্পকথা। কলকাতার মুছে যাওয়া অংশ হয়ে মুখ মোছে নানকিং…
আরও পড়ুন
হেস্টিংসের সঙ্গে কলকাতায় এল পিয়ানো, ভারতচন্দ্রের গানে সুর তুললেন রুশ সাহেব
Powered by Froala Editor