কলকাতার প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গী অঞ্চল। শুধু আজ নয়, সেই ইংরেজ আমল থেকেই একের পর এক ইতিহাসের সাক্ষী এই এলাকা। কত বড়ো বড়ো বাড়ি, বিখ্যাত বিখ্যাত জায়গা— সব মিলিয়ে জমজমাট সব। এখানেই রয়েছে রাজভবন। যে সময়ের কথা, তখন ভারত স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। পঞ্চাশের দশক সবে শুরু হয়েছে। রাজভবনে তো অনুমতি ছাড়া কারোর প্রবেশ নিষেধ। সাধারণের তো নয়ই।
কিন্তু অনেকেই দেখছেন, একজন বৃদ্ধ মানুষ মাঝে মাঝেই এসে সটান ঢুকে যাচ্ছেন রাজভবনের ভেতর। রক্ষীরা কেউ কিছু বলছেও না। কী হল ব্যাপারটা? ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতেই একাংশ চিনতে পারলেন ওই বৃদ্ধ ব্যক্তিটিকে। এ যে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত; মানে দাদাঠাকুর! এসেছেন ‘বন্ধু’র সঙ্গে একটু দেখা সাক্ষাৎ করতে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। দাদাঠাকুর যাঁর কথা বলছেন, তিনি আর কেউ নন, ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃতীয় রাজ্যপাল। আরও ভালো করে বললে, পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র পূর্ণ সময়ের রাজ্যপাল, যিনি ছিলেন বাঙালি!
বাঙালি মানে যাকে বলে ফ্রম টপ টু বটম; আদ্যোপান্ত বাঙালি। আর হবেন নাই বা কেন। এত বিশাল জায়গায় গিয়েও মনটা যে মাটির দিকেই পড়ে রয়েছে। যেমন স্বভাব, তেমন ব্যক্তিত্ব, তেমনই তীক্ষ্ণ মেধা। অবশ্য স্রেফ রাজ্যপাল হিসেবেই তাঁকে মনে রাখেনি ইতিহাস। পড়াশোনায় ছিলেন তুখোড়। হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে প্রথম ডক্টরেট। পরে সেই বিভাগের প্রধানও হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়তেই আরও নানা পদে ছিলেন তিনি।
এঁর মাঝেই বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম সদস্য ছিলেন। একসময় এগিয়ে এল স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ। কিন্তু স্বাধীন একটি দেশের জন্য তো স্বতন্ত্র নিয়ম চাই, আইন চাই। তার কী হবে? শুরু হল সংবিধান তৈরির কাজ। তৈরির করা হল ড্রাফটিং কমিটি। সেই কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অফ ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয় হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়কে। এছাড়াও সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়েও তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন। মাইনরিটি রাইটস সাব-কমিটির চেয়ারম্যান পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। পরে, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের পদে বসেন তিনি। ১৯৫১ সালের ১ নভেম্বর রাজ্যের তৃতীয় এবং প্রথম বাঙালি রাজ্যপাল হিসেবে কাজ শুরু করেন ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়।
দাদাঠাকুরের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। হরেন্দ্রকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর বন্ধুত্বের, স্নেহের। একে অপরকে শ্রদ্ধাও করতেন। দাদাঠাকুরের ব্যঙ্গ ও রসিকতা তো কিংবদন্তিসম। সেই রস থেকে বঞ্চিত ছিলেন না হরেন্দ্র। তাঁর কড়া নির্দেশ থাকত, দাদাঠাকুর এলে যেন কেউ তাঁর পথ না আটকান। একদিন রাজভবনে ঢোকার পরেই রাজ্যপাল কুশল জিজ্ঞাসা করছেন। আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা, এই প্রশ্নটাই করেছেন তখন। দাদাঠাকুরের বক্তব্য, ‘কিছু অসুবিধা হয়নি। একজন নরকের সঙ্গী আমাকে এগিয়ে দিয়ে গেছে।” এই কথাটা শুনে রাজ্যপাল একটু ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গেলেন। নরকের সঙ্গী! সেটা আবার কী? দাদাঠাকুরের বক্তব্য, ‘ওই যে, যাঁদের মাথায় হেলমেট থাকে, তারাই তো নরকের সঙ্গী । হেল মানে নরক আর মেট মানে সঙ্গী!’
এইরকমই একদিন কথাবার্তায় হঠাৎ দাদাঠাকুর বলে উঠলেন, ‘আপনার নামটা ভুল।’ হরেন্দ্রকুমার তো অবাক! বলেন কী! এতদিন এই নামটা ব্যবহার করছি, বাপ-ঠাকুরদার দেওয়া, ভুল হয় কী করে? এই প্রশ্নটিরই অপেক্ষা করছিলেন দাদাঠাকুর। সঙ্গে সঙ্গে জবাব, ‘আপনি যা উপার্জন করেন, তার সবই দান করেন। অথচ আপনার নাম হরেন। কিন্তু আপনি তো হরণ করেন না!’ মজার কথা হলেও, হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্বভাবটাই ছিল সেরকম। একদম সাদাসিধা জীবন। যেটুকু দরকার না হলেই নয়, সেটুকু নিয়ে থাকতে চান তিনি। যা রোজগার করেন, সবই দান করে দেন। আগেও এমনটা করেছিলেন। অধ্যাপক থাকাকালীনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথমে তিন লাখ, পরে আরও এক লাখ টাকা দান করেন। সেই সময় এই টাকার মূল্য আরও বেশি ছিল। এছাড়াও যখন তিনি সেখানকার ইন্সপেক্টর, তখনও খ্রিস্টান যুবকরা যাতে ঠিকঠাক শিক্ষা পায়, অসুবিধা না হয় সেটা দেখতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বাবা-মা’র নামে একটি ফান্ডও তৈরি করেন। প্রথমে দুই লাখ, পরে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা সেখানে দেন।
খ্রিস্টানদের জন্য নিজের জীবৎকালে অনেক কিছু করেছেন তিনি। নিজে একসময় অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ান খ্রিস্টানস’-এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ধর্মের বিভেদকে ঘৃণা করতেন তিনি। মানুষ হিসেবে সবাইকে দেখার চর্চা ছিল তাঁর। হিন্দু হোক বা মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ— প্রত্যেকে একই দেশের নাগরিক। তার থেকেও বড়ো কথা, সবাই মানুষ। এই আদর্শকেই জীবনের পাথেয় করেছিলেন হরেন্দ্রকুমার। যখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হলেন, তখনও সেখান থেকে সরে আসেননি। এই পদে থাকার সময়ই আরও একটি স্মরণীয় কাজ করেন। ১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি, কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে ভারত সরকারের তরফ থেকে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সূচনা হয়। সেই প্রথম চলচ্চিত্র উৎসবের প্রধান বক্তা ও উদ্বোধক ছিলেন মাননীয় রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু শরীর যে দিচ্ছিল না। কাজের মধ্যে থেকেছেন, ছাত্র পড়িয়েছেন, নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন; কিন্তু শরীর বাধ মানছে না। কাজ করতে করতেই, ১৯৫৬ সালের আগস্টে মারা যান রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়। বয়স তখনও ৭০ পেরোয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর আরও এক বাঙালি, ফণীভূষণ চক্রবর্তী রাজ্যপাল হন; কিন্তু সেটা মাত্র তিন মাসের জন্য। পূর্ণ সময় অবধি তাঁর মেয়াদ ছিল না। তারপর আজ পর্যন্ত বাংলা কোনো পূর্ণ সময়ের বাঙালি রাজ্যপালকে পায়নি। ডঃ হরেন্দ্রকুমারই এক এবং একমাত্র। তবে মারা যাওয়ার আগেও, নিজের সারা জীবনের কাজের সঞ্চয় ১৭ লাখ টাকা দিয়ে যান তাঁর সাধের প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে। একপ্রকার নিঃস্ব হয়েই তাঁর মৃত্যু! এমন মৃত্যুও তো সুখের…
Powered by Froala Editor