মে মাসের সকাল। আকাশে রোদ বেশ তীব্র। তার মধ্যে একটু একটু করে দুপুর হচ্ছে। কিন্তু সূর্য যতই মাথার উপরে উঠছে, পার্ক স্ট্রিটে ওরিবেলুনে চেপে আকাশে উড়লেন এন্টাল গ্যাস কোম্পানির সামনের খোলা মাঠে ততই বাড়ছে ভিড়। যেন একটা সার্কাসই দেখতে এসেছেন তাঁরা। শুধু সার্কাসের তাঁবুর বাইরে হবে এই খেলা।
কাতারে কাতারে জমা হওয়া মানুষের সামনে ফুলে উঠল বিরাট একটা বেলুন। প্রথমে একটু ডানদিক-বাঁদিক টলমল করতে করতে মাথা তুলে দাঁড়াল সেই বেলুন। তারপর তার নিচের চৌকোণা ঝুড়িতে এসে বসলেন এক বাঙালি। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দড়ি ছেড়ে দিতেই সোজা আকাশের দিকে উঠতে থাকল সেই বেলুন। সেদিনের সেই আরোহীই ছিল প্রথম গগনবিহারী বাঙালি। নাম রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর আগে অবশ্য সাহেবদের বেলুনে চড়ে আকাশে পাড়ি দিতে দেখেছে কলকাতাবাসী। কিন্তু কোনো বাঙালিকে এমন দুঃসাহসিক অভিযানে এগিয়ে আসতে দেখেননি কেউই। ‘অন্নপায়ী বঙ্গবাসী’ বিশেষণকে রীতিমতো ভুল প্রমাণ করে সেদিন আকাশে উড়েছিলেন রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দিনটা ১৮৮৯ সালের ৪ মে।
অবশ্য বাঙালির অলস চরিত্রকে নস্যাৎ করে অ্যাডভেঞ্চারের নমুনা আগেও রেখেছেন রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সে যুগে ট্রাপিজের খেলা শিখেছিলেন তিনি। প্রিয়নাথ বোসের ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’-এ খেলা দেখিয়েছেন তিনি। এমনকি ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’-এর প্রশিক্ষক ছিলেন বলেও শোনা যায়। বেলুনে চড়ার ইচ্ছা ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু তার নানা কৌশল তো শিখতে হয়। এমন সময় ১৮৮৯ সালেই মার্চ মাসে স্পেনসার নামে এক ইংরেজ সাহেব রেসকোর্সের মাঠ থেকে বেলুনে চড়ে আকাশে উড়লেন। ভিড় জমেছিল তাঁকে ঘিরেও। অনেকেই ছুটে এসেছিলেন এই কৌশল শিখতে। তবে তাঁদের সবাই ছিলেন বিদেশি। কেবল একজন বাঙালি যুবক ছিলেন সেই দলে। রামচন্দ্রকে পেয়ে খুশি হয়েছিলেন স্পেনসার সাহেবও। আর কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা আয়ত্ত করে নিলেন দক্ষ বাঙালি শিষ্য।
তবে শুধু কৌশল শিখলেই তো হবে না। জলে না নেমে যেমন সাঁতার শেখা যায় না, তেমনই আকাশে না উড়ে বেলুন আরোহন শেখাও যায় না। কিন্তু তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন একটা বেলুন। সেটা অবশ্য কিনে নিতে খুব সমস্যা হল না। তখনকার দিনে প্রতিটা বেলুনের নিজস্ব নাম থাকত। রামচন্দ্র যে বেলুন কিনলেন, তার নাম ছিল ‘দ্য ভাইসরয়’। এই নাম অবশ্য পছন্দ হল না খাঁটি বাঙালি রামচন্দ্রের। কেমন ঔপনিবেশিক গন্ধ নামের মধ্যে। তাই বদলে নাম রাখলেন ‘সিটি অফ ক্যালকাটা’। হ্যাঁ, নিজের শহরের নামকেই আকাশে তুলে ধরবেন তিনি। বেলুন ছাড়াও প্রয়োজন চৌকোনা ঝুড়ি, মোটা দড়ি। সেসবও জোগাড় হল। তবে নিরাপদে নামার জন্য প্রয়োজন একটা প্যারাস্যুট। সেটাও তৈরি হল তসরের কাপড় দিয়ে। আর প্রয়োজন শুধু বেলুনে ভরার জন্য খানিকটা গ্যাস। সেটা মিলল কলকাতার স্ট্রিট ল্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির কাছ থেকে।
আরও পড়ুন
কলকাতার বুকেই দেশের প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ, ইতিহাস সৃষ্টি করলেন বাঙালি ডাক্তার
অবশেষে ৪ মে ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রথম বাঙালি তো বটেই, সম্ভবত প্রথম ভারতীয় হিসাবেও বেলুনে চড়েছিলেন রামচন্দ্র। এই দুঃসাহসিক অভিযানে বাহবা জানিয়েছিলেন কলকাতার সাহেব-মেমরাও। এরপর দিল্লির তিস হাজরি মাঠ এবং লাহোরের টাউন হল মাঠেও একই খেলা দেখান তিনি। তখন অবশ্য রীতিমতো পাকা খেলোয়াড় তিনি। ঠিক মাঝ আকাশ থেকে প্যারাস্যুট খুলে ঝাঁপ দেন অনায়াসে। হাততালিতে ফেটে পড়ে মিলিত জনতা। তাঁর বেলুনের নাম তখন ‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’। বেলুনে চড়ে পুরস্কার পেলেন নবাব মুমতাজ আলি খানের কাছ থেকে। তবে স্পটলাইট বেশিদিন থাকল না তাঁকে ঘিরে। বুদ্ধিজীবীরা ততদিনে বলতে শুরু করেছেন, এ খেলা দুঃসাহসিক বটে। কিন্তু তার ফলে তো মানুষের লাভ হয় না কিছুই। ফলে এ নিয়ে এত মাতামাতি করার কোনো মানেই হয় না।
১৮৯২ সালের ৯ আগস্ট কলকাতায় গোপাল চট্টোপাধ্যায়ের বাগানবাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। কিন্তু ততদিনে সংবাদপত্র তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি তাঁর মৃত্যুসংবাদও প্রকাশিত হল না কোনো সংবাদপত্রে। বাঙালি কি আজও সেভাবে মনে রেখেছে তাঁকে? তবে উনিশ শতকের বাঙালির ইতিহাস লিখতে বসলে এই ঘটনা অস্বীকার করা যাবে না নিশ্চই।
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম অস্কার বিজয়ী তিনিই, ৯১ বছর বয়সে প্রয়াত ভানু আথাইয়া
তথ্যসূত্রঃ সাবেক কলকাতার ইতিকথা, জলধর মল্লিক
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা