গল্পের বইটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। টানটান উত্তেজনার মুহূর্তে হঠাৎই পাশের বন্ধুটি সেই বইয়ের কাহিনি বলতে শুরু করলেন। বিষয়টি একেবারেই পছন্দ হল না সার্গেই সাভিৎস্কির। বইয়ের বর্ণনা শেষ হওয়ার আগেই কাহিনি জেনে যেতে আর কেই বা চান? বারবার চুপ করতে বললেন তিনি। এদিকে বন্ধুটিও ততক্ষণে মজা পেয়ে গিয়েছেন। তিনি আরও বেশি রাগিয়ে দিতে থাকেন সাভিৎস্কিকে। শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে সোজা রান্নাঘরে ছুটে গেলেন সাভিৎস্কি। ছুরি নিয়ে এসে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়লেন বন্ধুর ওপরে। বছর তিনেক আগে এভাবেই ঘটে গিয়েছিল আন্টার্কটিকার (Antarctica) বুকে প্রথম এবং একমাত্র হত্যার চেষ্টা (Attempt to Murder)। গল্পের বইয়ের স্পয়লার দেওয়ার কারণেই ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল জনবিরল এই মহাদেশটির নামও।
সার্গেই সাভিৎস্কি একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আর তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরেক ইঞ্জিনিয়ার ওলেগ বেলগুৎজোভ। দুজনে প্রায় ৪ বছর ধরে আন্টার্কটিকায় একসঙ্গে গবেষণা চালিয়েছেন। তবে শেষদিকে দুই বন্ধুর সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হয়ে আসছিল। এদিকে তাঁদের একসঙ্গে কাজের মেয়াদও ফুরিয়ে আসছিল। শেষ বছরে তাঁরা ছিলেন চিলির কাছাকাছি কিং জর্জ দ্বীপে। আন্টার্কটিকা মহাদেশের অংশ হলেও এই দ্বীপটি ঠিক মেরু অঞ্চলের অংশ নয়। তুন্দ্রা অঞ্চলের মধ্যে পড়ে কিং জর্জ দ্বীপ। যদিও মানুষের বসতি সেখানে নেই। সারা বছর বরফ না থাকলেও ২০১৮ সালের অক্টোবরে বেশিরভাগ এলাকাই তখনও বরফে ঢাকা ছিল। এদিকে গ্রীষ্ম এসে পড়েছে। দিনে ১২ ঘণ্টা সূর্যালোক পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। এই রোদে গা গরম না হলেও বই তো পড়াই যায়।
সাভিৎস্কি আন্টার্কটিকার দিনগুলি কাটাতেন বই পড়েই। রাশিয়ার লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই সংগ্রহের সুযোগও ছিল। তবে তিনি যে বইই পড়তে যেতেন, দেখতেন বেলগুৎজোভের তা আগেই পড়া আছে। প্রথম প্রথম নিজের স্মৃতি পরীক্ষা করতেই গল্পগুলো বলতে শুরু করতেন তিনি। কিন্তু পরে মূলত সাভিৎস্কিকে রাগানোর জন্যই এমনটা করতেন। তাই একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বেলগুৎজোভকে ছুরি মেরে বসলেন সাভিৎস্কি। সঙ্গে সঙ্গে আন্টার্কটিকার সমস্ত গবেষণাকেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। দ্রুত চিলিতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বেঁচে গিয়েছিলেন বেলগুৎজোভ। আর এদিকে সাভিৎস্কিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হয় সেন্ট পটার্সবার্গে।
প্রায় ৪ মাস ধরে চলে সাভিৎস্কির বিচার প্রক্রিয়া। বারবার তিনি একটা কথাই বলেছেন, তাঁর কোনো অনুতাপ নেই। যে মানুষ অন্য একজন মানুষকে গল্পের বই পড়ার আনন্দ নিতে দেয় না, তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই বলেই মনে করেন তিনি। ইতিমধ্যে বেলগুৎজোভ সুস্থ হয়ে রাশিয়ায় ফিরেছিলেন। বিচারে হয়তো সাভিৎস্কির মৃত্যুদণ্ডই হয়ে যেত, যদি না বেলগুৎজোভ বাধা দিতেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালতে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানান তিনি। পাশাপাশি সাভিৎস্কিকে বই পড়ার সময় বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাও চান তিনি। আবারও দুজন রাশিয়ার দক্ষিণ মেরু গবেষণাকেন্দ্রের কাজে যোগ দিয়েছেন। তবে আবার কোনোদিন তাঁদের একইসঙ্গে একই গবেষণাগারে কাজ করতে হলে পরিস্থিতি কী হয়ে উঠতে পারে, সেটা আন্দাজ করা কঠিন। হয়তো পুরনো সব কথা ভুলে আবারও সহজ বন্ধুত্বে মেতে উঠবেন দুজনে। অথবা ভিতরে ভিতরে দুজনেরই রাগ জমে থাকবে। ভবিষ্যৎ যাই হোক, ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা চিরকাল থেকে যাবে।
Powered by Froala Editor