কপালে ছাই দিয়ে এঁকে দেওয়া হয় ক্রুশচিহ্ন, এই খ্রিস্টান উৎসবের তাৎপর্য কী?

একহাতে ধরে ছোট্ট পাথরের পাত্র। তাতে কানায় কানায় ভর্তি ছাই। সেই ছাই দিয়েই গির্জায় উপস্থিত ভক্তদের কপালে ক্রুশচিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন ধর্মযাজক। সনাতন ধর্মে যজ্ঞ বা হোমের পর ঠিক যেভাবে টিপ দেওয়া হয় ভক্তদের কপালে, অনেকটা তেমনই। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্মে যে হোম বা যজ্ঞের বালাই নেই কোনো। তবে এই বিশেষ রীতির গুরুত্ব কী? নাম-ই বা কী এই আশ্চর্য উৎসবের?

‘অ্যাশ ওয়েডনেসডে’। হ্যাঁ, খ্রিস্টানদের কাছে এই নামেই পরিচিত এই বিশেষ উৎসব। নামের মধ্যে ‘অ্যাশ’-এর উল্লেখ থেকেই বোঝা যায় এই উৎসবে ছাই-এর মাহাত্ম্য ঠিক কতটা। সঙ্গে এও বোঝা যায় কোনো এক বিশেষ বুধবারই পালিত হয় এই উৎসব। তার তাৎপর্য কী? মূলত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ মার্চের মধ্যে একটি বুধবার পালিত হয় ‘অ্যাশ ওয়েডনেসডে’ (Ash Wednesday)। অবশ্য একসময় ইস্টারের ছ’সপ্তাহ আগের বুধবারেই পালিত হত এই উৎসব। তার পিছনে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাসও। এই ইতিহাস বুঝতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দু’হাজার বছর। 

দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকের কথা। ইস্টারের আগের দু’দিন পাপস্খলনের দিন হিসাবে পালিত হত সে-সময়। এই দুইদিন উপবাস করতেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা। পরবর্তীতে এই সময়সীমা দীর্ঘায়িত করে এক সপ্তাহ ধার্য করা হয়। যা চিহ্নিত করা হত ‘পবিত্র সপ্তাহ’ নামে। ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে এই নিয়মে আবারও বদল আনে ভ্যাটিকান। জানানো হয়, এক সপ্তাহ নয়, বরং ৪০ দিন ধরে চলবে এই উদযাপন। ৪০ দিন ধরে দিনেরবেলায় উপবাস করতে হবে খ্রিস্টানদের। এই সময়কালে নিষিদ্ধ করা হয় মাংসভক্ষণ। এই বিশেষ উদযাপনকে নাম দেওয়া হয় ‘লেন্ট’। দেখতে গেলে অনেকটা ইসলাম ধর্মের রমযানের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় এই উৎসবের। দুই ধর্মের এই দুটি উৎসবের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, এমনটাও দাবি অনেকের। সেই বিতর্কে না হয় আসা যাবে অন্য একদিন। কিন্তু কোনো পূর্ণ সপ্তাহ না হয়ে কেন ৪০ দিন রাখা হল এই উৎসবের সময়সীমা?

আসলে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ৪০ দিন মরুভূমিতে কাটিয়েছিলেন স্বয়ং যিশু। এইসময় একাধিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। ছিল না পর্যাপ্ত খাবার, পানীয়। আর সেই কারণেই ৪০ দিন ধরে উপবাসের ধারণা। পাশাপাশি বাইবেল অনুযায়ী, বিশ্বে মহাপ্রলয় তথা ভয়াবহ সেই বন্যাও স্থায়ী হয়েছিল ৪০ দিন। কাজেই পাপস্খলন করে প্রকৃতি ও ঈশ্বরকে তুষ্ঠ করার একটি আঙ্গিকও ছিল এই উপবাস উদযাপনের মধ্যে। 

অবশ্য শুধু উপবাসই নয়, তথাকথিত ‘পাপী’-দের কঠোর জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে যেতে হত এইসময়। সভ্য সমাজ থেকে দূরে গিয়ে অরণ্যে তপস্যা করতে হত তাঁদের। অনেকটা ব্রহ্মচর্যের মতোই। পাশাপাশি খাবার বলতে শাকসবজি, ফলমূল। সঙ্গে সুতির জামাকাপড়ের পরিবর্তে পরিধান করতে হত চটের ভারি বস্ত্র। তবে কাউকেই এই উপবাস করতে বাধ্য করা হত না। বরং, সাধারণ মানুষ নিজেদের পাপস্খলন করতে স্বয়ং হাজির হতেন এই উৎসবে। 

অষ্টম শতক থেকে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এই বিশেষ উপবাসপ্রথা। দশম শতকে শেষ উল্লেখ পাওয়া যায় এই দীর্ঘ উপবাসরীতির। বদল আসে অ্যাশ ওয়েডনেসডের রীতিতে। ঠিক হয় লেন্ট শুরুর ঠিক দেড় সপ্তাহ পরের বুধবারটিতে পালিত হবে অ্যাশ ওয়েডনেসডে। আর সেদিন যে ছাই ব্যবহৃত হবে শুভ প্রতীক হিসাবে, তা তৈরি করা হবে লেন্টের প্রথমদিন অর্থাৎ রবিবারে গির্জায় পোড়ানো পাম ফল থেকে। এই রীতি থেকেই লেন্টের প্রথম রোববারের নামও হয়ে যায় ‘পাম সানডে’। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপবাস রাখার প্রথা অবলুপ্ত হয়েছে। বদলে ইস্টারের মতোই ‘অ্যাশ ওয়েডনেসডে’-ও পরিণত হয়েছে আনন্দের উৎসবে, মধাহ্নভোজের উৎসবে। এমনকি মজার বিষয় হল, এই দিনটিকে কেন্দ্র করেই ব্রাজিলের মতো দেশে আয়োজিত হয় কার্নিভাল। ‘কার্নিভাল’ কথাটির মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি ধাঁধাঁ। তা হল ‘কার্ন এ ভাল’। পর্তুগিজ ভাষা থেকে বঙ্গানুবাদ করলে যার মানে দাঁড়ায় ‘বিদায়ের আগে শেষ মিলন’। অর্থাৎ, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে ভক্তদের সঙ্গে যিশুর শেষ সাক্ষাৎ। একসময় ধর্মীয় সঙ্গীত গেয়ে যে উদযাপন চলত, আজ তা পরিণত হয়েছে বর্ণময় শোভাযাত্রায়। লেন্টের প্রথম সপ্তাহেই মূলত আয়োজিত হয় এই অনুষ্ঠানটি। শেষ হয় অ্যাশ ওয়েডনেসডে-তে। গত ২২ ফেব্রুয়ারিই ইতি পড়েছে কার্নিভালের। আর এই দিনটিই ছিল অ্যাশ ওয়েডনেসডে। এবার ইস্টারের অপেক্ষা। মৃত্যুর পরেও আবার ফিরে আসবেন তিনি…

Powered by Froala Editor