“সেদিন আকাশে জলভরা মেঘ / বৃষ্টির বেদনাকে বুকে চেপে ধরে থমকে দাঁড়িয়েছিলো”। কাকদ্বীপ গণবিক্ষোভের সময় এই কথাগুলো লিখেছিলেন সলিল চৌধুরী। তারপর অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। তবু ২০২০ সালে দাঁড়িয়েও এই কয়েকটি শব্দের তাৎপর্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন কৃষকরা। সারা দেশজুড়ে সবে উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই সময় একটু শীতঘুম পায় মানুষেরও। কিন্তু ওঁদের চোখে ঘুম নেই। আছে না পাওয়াকে ছিনিয়ে নেওয়ার তীব্র অঙ্গীকার। আর সেই অঙ্গীকারের আগুনে শরীরটা সেঁকে নিয়ে দলে দলে মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন রাজধানী দিল্লি শহরের দিকে।
চলতি বছরে এই নিয়ে তৃতীয়বার। করোনা মহামারীর মধ্যেও জোট বেঁধেছেন কৃষকরা। প্রথমে মার্চ মাসে, তারপর সেপ্টেম্বর। এবার আরও বড়ো লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তাঁরা। সঙ্গে মাসখানেকের খাবার নিয়ে নিয়েছেন সকলেই। দাবি পূরণ না হলে রাজধানী থেকে ফেরার যেন কোনো প্রশ্নই নেই। আর কোথা থেকে আসছেন কৃষকরা? দিল্লির উপকণ্ঠের কৃষকরা যেমন আছেন তেমনই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এমনকি রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ থেকেও পায়ে হেঁটে আসছেন কৃষকরা। হ্যাঁ, পায়ে হেঁটেই। রাস্তায় জলকামান, কাঁদানি গ্যাস বা পুলিশের ব্যারিকেড কিছুই আটকাতে পারেনি। জলকামানে সারা শরীর ভিজে যাওয়া কৃষক ১০টা ব্যারিকেড টপকে এসে দিল্লির রাজপথে রোদ পোহাচ্ছেন। সত্যিই যেন একটা অন্যরকম দৃশ্য।
কৃষকদের লড়াইতে ইতিমধ্যে সমর্থন জানিয়েছে দেশের বেশ কিছু বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দল। হয়তো এই সূত্রে কেন্দ্র সরকারকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলার প্রচেষ্টা। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, ভারতে কৃষি-অর্থনীতি নিয়ে জটিলতা এই প্রথম নয়। এদেশে কোম্পানি শাসনের সঙ্গে সঙ্গেই পুরনো কৃষিব্যবস্থায় ভাঙন ধরতে শুরু করে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপেই তাঁরাও খুব একটা তারাহুড়ো করেননি। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকেই কৃষকরা ক্রমশ বড়ো পুঁজির আওতায় চলে আসছেন। ৯০-এর দশকে উদার অর্থনীতির অনুপ্রবেশে অবস্থাটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, এদেশে প্রতি বছর ৭ শতাংশের বেশি কৃষক শুধু ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেন। সংখ্যাটা কোনো বছরই ৪০ হাজারের কম নয়।
তবে এর পরেও কোনোরকমে টিকে ছিলেন কৃষকরা। এখনও কৃষিজাত পণ্যের জন্য খোলা বাজারেই ছোটে মানুষ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বহু মানুষ। সকলেই অবশ্য কৃষক নন। কিন্তু সদ্য পাশ হওয়া কৃষি আইনে এই বাজার অর্থনীতিই পুরোপুরি ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কৃষকরা। না, শুধুই পুঁজিপতিদের দাসত্ব করে দিন কাটাবেন না তাঁরা। শুক্রবার সারাদিন সাক্ষী থাকল সেই লড়াইয়ের। পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তে পুলিশের সঙ্গে কৃষকদের একাধিক সংঘর্ষ ঘটে গেল। তবে এরই মধ্যে দিল্লি সরকার জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়াবেন। মধ্যপ্রদেশ সরকারও কৃষি আইন লাগু হতে দেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। নানা রাজ্যেই আইন-শৃঙ্খলার অবনতি দেখা যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের শেষ কোথায়, সেটা আন্দোলনই বলবে।
আরও পড়ুন
কোথাও রেল-রোকো, কোথাও পথ অবরোধ; কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সাক্ষী গোটা দেশ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দেশজুড়ে পথে নামছেন কৃষকেরা, কৃষি বিল কি পালে হাওয়া তুলে দিল বিরোধীদের?