১৯৪৩ সাল। ইতালিতে তখন চলছে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলছে এক বিরাট মারণযজ্ঞ। নৃশংসতায় কম যায়নি মিত্রশক্তির দেশগুলিও। তবে ইতালি-জার্মানিতে ইহুদি ও প্রতিবাদী কণ্ঠের মানুষদের হত্যা করা হয়েছিল নির্মমভাবে। বিবেকবান মানুষ অপেক্ষা করেছে এই যুদ্ধের অবসানের জন্য। অনেকে বুদ্ধির বলে বাঁচিয়েছিলেন বহু মানুষের প্রাণ। রোমের ফাতেব্রেনেফ্রাতিলি হাসপাতালে (Fatebenefratelli Hospital) ঘটেছিল সেরকমই এক ঘটনা।
অন্য আরেকটি কারণেও সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল হাসপাতালটি। ইতালির অন্যান্য হাসপাতালগুলি তখন বশ্যতা স্বীকার করেছিল ফ্যাসিস্ট পার্টির কাছে। প্রত্যেকটির মাথাতেই ছিল মুসোলিনির দলের কর্তাব্যক্তিরা। ফলে কাকে, কখন সেগুলিতে ভর্তি করা হচ্ছে, তার পূর্ণ বিবরণ থাকত তাদের কাছে। শুধুমাত্র ফাতেব্রেনেই চলত চার্চের অধীনে। আর সেই কারণে এই হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছিলেন জিওভান্নি বরোমেও (Giovanni Borromeo)। মতের দিক থেকে তিনি ছিলেন ফ্যাসিবিরোধী। অন্যান্য হাসপাতালে অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা সত্ত্বেও শুধুমাত্র আদর্শের জন্য এসেছিলেন ফাতেব্রেনেতে। এমনকি তিনি বেছে নিয়েছিলেন সেই সব ডাক্তারদের, যারা কোনো না কোনোভাবে ফ্যাসিস্ট পার্টির দ্বারা নির্যাতিত কিংবা দলদাস না হওয়ায় স্বীকৃতি পাননি নিজের প্রতিভার।
এদিকে প্রতিদিন বহু মানুষকে ভর্তি করা হচ্ছে হাসপাতালে। রোগ বলতে অনাহার আর নির্মম অত্যাচার। ইতালির ‘ঘেটো’গুলিতে পশুর মতো দিনযাপন করতে হত ইহুদি আর প্রতিবাদী চেতনার মানুষদের। মৃত্যুও হয়েছিল বহু লোকের। ১৯৪৩-এর ১৬ অক্টোবর, জিওভান্নির অধীনে আসে কয়েকজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগী। প্রত্যেকেই ‘রাজনৈতিক বন্দি’, ফলে তাদের বাঁচিয়ে রাখারও কোনো দায় নেই প্রশাসনের। ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশরা সবসময়ে নজরে রাখত যেন কোনোভাবেই ভালো চিকিৎসা না হয় তাদের। যদি তারা সুস্থ হয়ে ওঠে, তাহলেও মৃত্যু অনিবার্য। ঘরে-বাইরে বিপদ দেখে প্রমাদ গুণলেন জিওভান্নি। হাসপাতালের আরো দুজন ডাক্তার ভিত্তোরিও সাকেরদোতি (Vittrio Sacerdoti) ও আদ্রিয়ানো ওসিসিনি (Adriano Ossicini) এগিয়ে এলেন তাঁকে সাহায্য করার জন্য। এবং তাঁদের মাথা থেকে বেরোল এক আশ্চর্য বুদ্ধি।
তাঁরা এই রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা করলেন হাসপাতালে। যেখানে প্রবেশাধিকার নেই অন্য কারোর। রটিয়ে দিলেন এরা আক্রান্ত হয়েছেন জটিল ও ছোঁয়াচে ‘কে-সিনড্রোম’ নামের এক রোগে। যার কোনো প্রতিষেধক নেই এবং এই রোগে আক্রান্তদের মৃত্যু প্রায় অনিবার্য। এরপরে নাৎসিরা যেসব বন্দিদের নিয়ে আসতেন, প্রত্যেকেরই ঠাঁই হত এই বিশেষ ওয়ার্ডে। প্রথমদিকে সত্যিই ভয় পেয়েছিল নাৎসিরা, বিশ্বাস করেছিল জিওভান্নির কথায়। কিন্তু অক্টোবরের শেষ দিকেই সন্দেহ হতে থাকে তাদের। একবার তারা পরিকল্পনা করে গোপনে হাসপাতালে হানা দেওয়ার। এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন জিওভান্নি ও তাঁর সহকর্মীরা। প্রতিরোধ নয়, বরং সাগ্রহেই হাসপাতালে আমন্ত্রণ জানালেন নাৎসি সৈন্যদের। এমনকি ‘কে-সিনড্রোম’-এর রোগীদের সরেজমিনে দেখার ব্যবস্থাও করে দিতে চাইলেন। আর তাতেই কিছুটা ভয় পেল নাৎসিরা। শেষ পর্যন্ত স্থগিত রাখে তাদের পরিকল্পনা।
আরও পড়ুন
হলুদ হয়ে যেত ত্বকের রং, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্র তৈরির অভিশাপ ‘ক্যানারি গার্লস’
অবশ্য নাৎসিদের আক্রমণের ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু মতামত রয়েছে। যেমন, ওসিসিনির মতে ‘কে সিনড্রোম’-এর পুরো ব্যাপারটিই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। কোনো বিশেষ ধর্মের বন্দিদের বাঁচানোর জন্য নয়, বরং নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ দেখানোর জন্য ছিল সমগ্র পরিকল্পনা। বিতর্ক আছে রোগীর সংখ্যা নিয়েও। যাই হোক না কেন, ওই ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে আশ্চর্য সাহস আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন জিওভান্নিরা। শাসকের অস্ত্রের সামনে জয় হয়েছিল মানবতার।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া প্রথম বাঙালি সৈনিক, বিস্মৃতির অতলে চন্দননগরের যোগেন্দ্রনাথ
Powered by Froala Editor