শুধু রোম নয়, নিরোর রাজত্বে ধ্বংস হয়েছিল এই উদ্ভিদও

আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগের কথা। এক আশ্চর্য ভেষজ উদ্ভিদের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন রোমান লেখক প্লিনি। সে-সময় সোনার দরেই কেনা-বেচা হত এই গাছের। হ্যাঁ, আশ্চর্য ঔষধি গুণাবলির জন্যই এত কদর ছিল এই বিশেষ গাছটির। কোষাগারে প্রায় সাড়ে ছশো কেজি এই গুল্ম সংগ্রহ করেছিলেন খোদ জুলিয়াস সিজার। তাছাড়া ৫৪-৬৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সম্রাট নিরো প্রায় উজাড় করে ফেলেছিলেন এই বিশেষ আগাছার বন। 

যে আশ্চর্য গাছটির কথা হচ্ছে তাঁর প্রাচীন নাম সিলফিয়াম (Silphium)। প্লিনির (Pliny) লেখা অনুযায়ী ক্ষত সারিয়ে তোলা থেকে শুরু করে আলসার, রক্তচাপের মতো সমস্যার সমাধান করতে পারত এই গাছের ফুল। তাছাড়া এই গাছের বীজের মধ্যে লুকিয়ে ছিল জন্মহার নিয়ন্ত্রণের রহস্যও। অনেকটা ‘হার্ট শেপ’ বা হৃদয় আকৃতির দেখতে এই বীজ খেলে নাকি সাময়িকভাবে গর্ভবতী হতেন না মহিলারা। এমনকি সেই থেকেই রোম্যান্সের সঙ্গে জুড়ে গেছে হার্ট শেপ। কিন্তু সত্যিই কি পৃথিবীর বুকে ছিল ‘ফেরুলা’ গণের এমন কোনো বিস্ময় গুল্ম? 

দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর ছিল না মানুষের কাছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে ধারণা। নেপথ্যে তুরস্কের গবেষক মাহমুদ মিসকি। আজ থেকে ৩৮ বছর আগে তুরস্কের কাপাডোকিয়া পার্বত্য অঞ্চলে এক অদ্ভুত উদ্ভিদের সাক্ষী হয়েছিলেন ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। হলুদ থোকা থোকা ফুল ফুটে রয়েছে তার ডালে। পাশাপাশি তার ঔষধি গন্ধও বেশ আকর্ষণীয়। 

হ্যাঁ, এই বিশেষ উদ্ভিদটিও ‘ফেরুলা’ গণের। তবে কি এটাই সেই আশ্চর্য সিলফিয়াম উদ্ভিদ? সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় ছিল না তাঁর কাছে। কারণ, তুরস্কজুড়ে প্রায় ১০০ প্রজাতির ‘ফেরুলা’ উদ্ভিদ জন্মায়। এই গাছ তেমনই একটি প্রজাতি হতে পারে, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় কী করে? মিসকি এই বিশেষ উদ্ভিদ প্রজাতির নামকরণ করণ ‘ফেরুলা ড্রুডেয়ানা’।

রহস্যের সমাধান করতেই গবেষণা শুরু করেছিলেন মিসকি। ফুলের সংগ্রহ করে শুরু হয়েছিল তার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা। ফলাফল হাতে পেয়েস রীতিমতো চমকে যান তিনি। ৩০টিরও বেশি মেটাবোলিক হাজির এই গাছের মধ্যে। যাদের মধ্যে কোনোটি অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, কোনোটা আবার কনট্রাসেপ্টিভ। আবার ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করার মতো রসদও লুকিয়ে এই গাছেই। উল্লেখ্য, রোমান লেখক প্লিনির বর্ণনার সঙ্গে যা মিলে যায় বহুক্ষেত্রেই। 

মিসকির বিশ্বাস ‘ফেরুলা ড্রুডেয়ানা’-ই তৎকালীন রোমের সেই আশ্চর্য সিলফিয়াম। তবে গবেষকদের একাংশ এখনও মানতে নারাজ এই গাছের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। কারণ, প্লিনির লেখায় যে গাছের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা পাওয়া যেত মূলত সাইরিন শহরে। বর্তমানে যা লিবিয়ায় অবস্থিত। এই গাছ অন্য কোথাও পাওয়া যেত না বলেই উল্লেখ করেছিলেন প্লিনি। ড্রুডেয়ানা যদি সিলফিয়ামই হয়ে থাকে, তবে তা তুরস্কে পৌঁছাল কীভাবে? থেকে যায় এই প্রশ্নই। সে যাই হোক না কেন, আশ্চর্যের বিষয় হল এমন এক আশ্চর্য গাছের সন্ধান পেয়েও তা সংরক্ষণ করতে পারেনি মানুষ। বরং, মানুষের খিদে ও চাহিদা মেটাতে গিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে সম্পূর্ণভাবে অস্তিত্ব মুছে গিয়েছিল এই প্রজাতিটির। সিলফিয়ামের মতো আজও বহু বহু উদ্ভিদ প্রজাতি প্রমাদ গুনছে অবলুপ্তির। দায়ী সেই মানব সভ্যতাই…

Powered by Froala Editor