যে-কোনো দেশের ক্ষেত্রেই, রাজধানীকে তার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। রাজধানী (Capital) থেকে যেমন পরিচালিত হয় দেশের সরকার, তেমনই রাজধানীই যে-কোনো দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতীক। নাগরিকদের কাছে জাতীয় গর্বও বটে। কিন্তু খোদ রাজধানীই যদি দেশের বাইরে অবস্থিত হয়?
হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যি। তবে ইতিহাস সাক্ষী আছে এমন অদ্ভুত ঘটনারও। রিও ডি জেনেইরোর প্রসঙ্গ উঠলেই যে-কারোর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’-এর ছবি, ফুটবল, সাম্বা নাচ, মারাকানা স্টেডিয়াম আর সবুজ-হলুদ পতাকার ছবি। কিন্তু ব্রাজিল নয়, বরং একটা সময় রিও (Rio) রাজধানী ছিল পর্তুগালের (Portugal)! হ্যাঁ, শুধু দেশের সীমানার বাইরেই নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন মহাদেশে রাজধানী তৈরি করেছিলের পর্তুগিজ শাসকরা। বিশ্বে এ-হেন দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই আর। কিন্তু এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কারণ কী?
দক্ষিণ ভারত অভিযানের সময় মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব যেমন তাঁর রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে, পর্তুগালের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল তেমন ঘটনা। তবে ব্রাজিল-জয় নয়, বরং এ-ক্ষেত্রে রীতিমতো প্রাণ বাঁচাতেই লিসবন ছেড়ে ব্রাজিলে রাজধানী তৈরি করে পর্তুগিজ রাজপরিবার।
শুরু থেকেই বলা যাক সেই গল্প। সময়টা উনিশ শতকের শুরুর দিক। সে-সময় ইউরোপের অন্যতম শক্তি হয়ে উঠেছে নেপোলিয়নের নেতৃত্বাধীন ফ্রান্স। ব্রিটেন, রোমান সাম্রাজ্য, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া-সহ ইউরোপের একটা বড়ো অংশকে নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন ফরাসি সম্রাট। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পরবর্তী হয়ে উঠতে পারে পর্তুগাল, এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল ১৮০৬ সাল থেকেই।
সে-সময় বিশ্বের অন্যতম বড়ো ঔপনিবেশিক শক্তি হলেও, নেপোলিয়নের বাহিনীকে ঠেকানোর মতো ক্ষমতা ছিল না পর্তুগিজদের কাছে। ফলে, প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়ায় সিদ্ধান্ত নেয় ব্রাগেঞ্জা রাজপরিবার। দিনটা ছিল ১৮০৭ সালের ২৯ নভেম্বর। ১০ হাজার নাগরিককে নিয়ে পর্তুগালের রানি প্রথম মারিয়া, প্রিন্স ষষ্ঠ জন পাড়ি দেন ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দেশের আইনজীবী, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদেরও। ব্রাজিলের রিও শহরেই গড়ে উঠেছিল তাঁদের রাজধানী।
পরবর্তীতে লিবারাল বিপ্লবের সময় ১৮২১ সালে দেশে ফিরে আসেন পর্তুগিজ সম্রাট ষষ্ঠ জন। তারও এক বছর পর ১৮২২ সালে পর্তুগালের রাজধানী পুনরায় সরিয়ে আনা হয় লিসবনে। অর্থাৎ, দেখতে গেলে ১৪ বছর দেশের বাইরে থেকেই দেশ চালিয়েছেন পর্তুগালের শাসকরা। অন্যদিকে সম্রাট ষষ্ঠ জন দেশে ফিরলেও, পর্তুগালে ফিরে আসতে নারাজ ছিলেন তৎকালীন রাজকুমার প্রথম ডম পেদ্রো। পরবর্তীতে ব্রাজিলের ‘রাজা’ হিসাবে ঘোষণা করা হয় তাঁকেই। এমনকি পর্তুগালের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করে ব্রাজিলকে স্বাধীন দেশের তকমা দেন তিনিই। আজও ব্রাজিলের নাগরিকদের কাছে ‘লিবারেটার’ বা ‘ন্যাশনাল হিরো’ হিসাবেই পরিচিত প্রথম পেদ্রো।
সে যাই হোক না কেন, পর্তুগিজ শাসকরা রিও ছাড়ার পরেও প্রায় ১৪০ বছর ব্রাজিলের রাজধানী ছিল এই শহর। ১৯৬০ সালে রিও থেকে ব্রাজিলিয়ায় রাজধানী স্থানান্তরিত করে ব্রাজিল প্রশাসন। তবে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে আজও ব্রাজিলের অন্যতম শহরগুলির মধ্যেই উচ্চারিত হয় ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’-এর শহর…
Powered by Froala Editor