"গরুর মাংসের গন্ধ শুঁকেই কসাইয়ের বউ স্থূল হয়ে উঠেছে।" এমন কথা শুনলে আজকাল অবাক হতেই হয়। কারণ শরীরে মেদ জমার কারণ আমরা প্রত্যেকেই জানি, এবং তার সঙ্গে গরুর মাংসের গন্ধের কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বিল্ডার পত্রিকায় এই বাক্যটি লিখেছিলেন একজন ডাক্তার। তাঁর নাম প্রফেসর এইচ. বুথ।
ভাবছেন কোনো রসোদ্রেক ঘটানোর জন্য লিখেছিলেন? মোটেও তেমন কিছু নয়। অধ্যাপক বিশ্বাস করতেন, মানুষের যাবতীয় রোগের উৎস আসলে গন্ধ। আরও ভালোভাবে বললে, দুর্গন্ধ। শুধু অধ্যাপক বুথ নন। উনিশ শতকের ইউরোপে অধিকাংশ চিকিৎসকরাই এই মতের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন একথা বিশ্বাস করেননি, তাঁরা হয়েছিলেন হাসির পাত্র। আসলে জীবাণু ও তার সংক্রমণ সম্পর্কে তখন কোনো ধারণাই ছিল না।
গন্ধের মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ধারণা মূলত চিনের তান্ত্রিকদের কাছ থেকে এসেছিল। সমস্ত রোগের পিছনেই কিছু বিশেষ গন্ধ থাকে, এবং তারা মূলত রাতের বেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই ছিল তত্ত্ব। পরবর্তীকালে ইউরোপে যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়, মিয়াসমা তত্ত্ব। সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে লন্ডন শহরে হঠাৎ এসে পড়ল এক উৎপাত। দীর্ঘদিন পর কলেরা রোগ আবার মহামারীর আকার ধারণ করেছে। ১৮৩৩ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত যে কতবার এই মহামারীর তাণ্ডব উপস্থিত হয়েছিল, তার সঠিক হিসাব নেই কোথাও। এদিকে অবস্থা এমন ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে যে সমাধান তো একটা বের করতেই হবে। আর তখনই লন্ডনের চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই মিয়াসমা তত্ত্ব।
সমীক্ষায় এই তথ্য স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল যে, কলেরার উপদ্রব বেশি শহরাঞ্চলে। অতএব শহরের পরিবেশেই লুকিয়ে আছে কারণ। গবেষকরা শুরুতেই সেই কারণটি আবিষ্কার করলেন। তা হল দূষণ। দূষণ বলতে মূলত বায়ু দূষণ বা পচা বর্জ্য পদার্থ থেকে নির্গত দুর্গন্ধ। বলা হল, এর মধ্যেই আছে এক ভয়ঙ্কর কণা, যার নাম মিয়াসমাটা। যে বাতাসে এই কণা থাকে তার নাম হল 'ব্যাড এয়ার'। আর এই খারাপ বাতাসের সংস্পর্শে এলেই ঘটবে সংক্রমণ। বহু চিকিৎসক এই মতের পক্ষে সওয়াল করলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন টমাস স্মিথ এবং ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেলের মত উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
মিয়াসমা তত্ত্বের কথা মোটামুটি সবাই মেনে নিলেন। ক্রমশ ঢেলে সাজানো হল শহরের নিকাশি ব্যবস্থা। স্যাডউইকের মত ছিল 'প্রত্যেক দুর্গন্ধই অসুখ'। অতএব সংক্রমণ এড়াতে সুগন্ধী দ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে গেল। চিকিৎসকরাও আতর ব্যবহার করতে শুরু করলেন। কিন্তু এতকিছু করেও কলেরার প্রাদুর্ভাব আটকানো গেল না। বরং তার সঙ্গে এল টাইফয়েড। ফলে চিকিৎসকদের ধারণায় কোথাও একটা গলদ আছে একথা বোঝা যাচ্ছিল। ওদিকে সেই ১৮৩৩ সাল থেকেই জন স্নো বলে যাচ্ছিলেন, দুর্গন্ধ কোনো কারণ নয়। দূষণ আসলে ঘটছে জলের মধ্যে। দূষিত জল থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে কলেরা। অতএব মহামারী আটকাতে গেলে জল পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্তত খাবার জল।
তখন অবশ্য সেকথা কেউ কানে তোলেননি। তবে ১৮৬০এর দশকেই লুই পাস্তুর আবিষ্কার করে ফেললেন তাঁর পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতি। পানীয় দ্রব্য আগে ফুটিয়ে নিলেই অনেক রোগের সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। লুই পাস্তুর জানালেন, পানীয় দ্রব্যের মধ্যেই আছে জীবাণু। আর ফুটিয়ে নেওয়ার ফলে সেই জীবাণু মরে যাচ্ছে। ফলে আর রোগের সংক্রমণ ঘটছে না। হাতেনাতে ফল পেলেন সবাই। ফলে লুই পাস্তুরের কথা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। আর ১৮৬৬ সালে পরিসংখ্যান বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফার দেখালেন, জন স্নোয়ের কথাই আসলে ঠিক। দূষিত জল থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে কলেরা।
১৮৬৬ সালে উইলিয়াম ফারের পর্যবেক্ষণ এবং লুই পাস্তুরের আবিষ্কার মিলিয়ে সংক্রমণের আসল কারণ বোঝা গেল। যদিও জীবাণুর প্রসঙ্গকে তখনও একটি তত্ত্বের আকারেই রাখা হয়েছিল। তবে এবার লন্ডনের নগর প্রশাসনের তরফ থেকে পানীয় জলের পরিশোধনের ব্যবস্থা করা হল। আর মজার ব্যাপার, তারপর আর লন্ডন শহরে কলেরা রোগটি কোনোদিন মহামারীর আকার ধারণ করেনি। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের শাস্ত্র থেকেও চিরতরে বিদায় নিল মিয়াসমা তত্ত্ব। আজকাল এমন কথা শুনলে তো রীতিমতো হাসি পায়। তবে বিপদের সময় অপবিজ্ঞান বা কুসংস্কারের কাছে যে শুধু সাধারণ মানুষই মাথা নোয়ায় না, বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও কলেরা মোকাবিলা করতে চিনা তন্ত্রের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন; একথা আজও আশ্চর্য করে।