শেষ পর্ব
রংপুরকে কেন্দ্র করে এই সময় সক্রিয় হয় বিদ্রোহীরা। উত্তরবঙ্গেও তাদের হাতে ধাক্কা খাচ্ছিল ইংরেজ। অত্যাচার করেও রাজস্ব আদায় হয় না। যে গ্রাম-সমাজকে ইংরেজরা ধ্বংস করেছিল, সেই গ্রাম-সমাজের সহায়তাতেই বিদ্রোহীরা শাসন ব্যবস্থাকে প্রায় অচল করে তুলেছিল। ইংরেজবাহিনী কোনোদিক থেকেই এঁটে উঠতে পারছিল না। এমনকি রণকুশলতাতেও। যেমন, একটা যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়। সেই আনন্দে ইংরেজ বাহিনী যখন গোলাগুলি শেষ করে ফেলেছে, তখন গ্রামবাসীদের নিয়ে চারদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিদ্রোহীরা। প্রথম পরাজয় আসলে ভান ছিল। বিদ্রোহীদের দাপটে নাভিশ্বাস ওঠে ইংরেজদের। শেষমেশ তাদের দমন করার কঠোর নির্দেশ আসে উপরমহল থেকে।
প্রথম পর্ব
ইংরেজদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন যে বাঙালি ফকির
ইংরেজদের সবরকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মজনু বিদ্রোহীদের একজোট করতে থাকেন। দিনাজপুরে তাঁর উপস্থিতি খবর পেয়ে ইংরেজ এত আতঙ্কিত হয় যে, রাজস্ব রক্ষায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কৌশলে যুদ্ধ এড়িয়ে মজনু বিদ্রোহীদের এককাট্টা করে হয়তো আরও ব্যাপক আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ এবং ফকিরদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ মিটিয়ে ঐক্য আনাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ জুড়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়ে এ কাজটি করতেও পেরেছিলেন। এই সময়ে ইংরেজদের চিঠিতে একাধিকবার মজনুকে নিয়ে তাদের আশঙ্কা ও আতঙ্কের কথা জানা যায়। শেষমেশ ১৭৮৬ সালে কালেশ্বর নামে এক জায়গায় মজনুর বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের সরাসরি যুদ্ধ বাধে। তরবারি হাতে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং মজনু। শত্রু বেষ্টনী ভেদ করে পালাতেও সক্ষম হন। কিন্তু মারাত্মক জখম হয়েছিলেন। ওই বছরই শেষের দিকে আত্মগোপনরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। ইংরেজরা শত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত মজনু শাহকে ধরতে পারেনি।
এর পরেও যোগ্য নেতারা কৃষক বিদ্রোহের ভার তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে তা স্তিমিত হয়ে আসে। সন্ন্যাসী ও কৃষক বিদ্রোহ যে ব্যাপক আকার নিয়েছিল, তা কেবলমাত্র মজনু শাহের নেতৃত্বের কারণে নয়। রামানন্দ গোঁসাইয়ের মতো আরও অনেকেই ছিলেন, যাঁরা সে সময় আগুন জ্বালিয়েছিলেন। মজনুর পরবর্তীতে ভবানী পাঠক বা দেবী চৌধুরানিও এই সংগ্রামের ইতিহাসে চলে আসেন। কিন্তু এ-কথা ঠিক যে, মজনু ফকিরই প্রথম সার্থকভাবে একটা বিদ্রোহকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। খণ্ডযুদ্ধ ও বীরত্বের প্রদর্শন নয়, অর্থ জোগাড় করে, গ্রামবাসীদের বিশ্বাস অর্জন করে, জমিদার শ্রেণির কাছে আবেদন জানিয়ে, অন্তর্কলহ মিটিয়ে, ধর্ম ও অন্যান্য ভেদাভদের ঊর্ধ্বে উঠে এবং সর্বোপরি ইংরেজদের আক্রমণ করে এক বৃহত্তর ও ব্যাপক বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। প্রথম বিদ্রোহী নায়কের শিরোপা তাই তাঁরই প্রাপ্য।
আমাদের চালু ইতিহাসে যে দেশপ্রেমিকদের আত্মদানের কথা আমরা শুনেছি এবং গৌরবের সঙ্গে তা স্মরণ করে থাকি, সেখানে সর্বাগ্রে ঠাঁই হওয়ার কথা মজনু ফকিরেরই। ফকির শব্দটি তার স্বীয় সম্মান পায় যখন তার সঙ্গে মজনু শাহের নাম মিশে থাকে, কোনও রাজনৈতিক বক্তৃতার করতালিমুখর চটক নয়। আসলে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ-কে নিয়ে নানা রাজনৈতিক দলই ছক্কা-পুট খেলছে। এর হাতে সাত ফুট মূর্তি থাকলে, ওর আস্তিনে তাই লোকানো দশ ফুট মূর্তির নকশা। এই দেশপ্রেমের প্রতিযোগিতা যে কী মারাত্মক, সে আমরা আজ হয়তো হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছি। আর সেই বিপর্যয়ের মুখেই মজনু শাহ হয়ে ওঠেন আমাদের বাঁশের কেল্লা। আমরা চিনতে পারি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বরূপ, যা ধর্ম নয়, কেবলমাত্র মানুষের অধিকার অর্জনের ভিত্তিতে-ই প্রতিষ্ঠিত। সেই স্বাধিকার অর্জনই দেশপ্রেম। কোনো আখ্যানই এর বিকল্প যেন না হয়ে উঠতে পারে, মজনু শাহের খোলা তরবারি যেন আমাদের সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।