২০২২-এর শুরুর দিক সেটা। তখনও পর্যন্ত ইউক্রেনে হানা দেয়নি রুশ বাহিনী। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিল একটি আশ্চর্য মৌল। ‘আইনস্টাইনিয়াম’ (Einsteinium)। হ্যাঁ, কিংবদন্তি পদার্থবিদ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছিল এই তেজস্ক্রিয় মৌলটির। ১৯২২ সাল। পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান আইনস্টাইন। আর তার ঠিক ১০০ বছর পর প্রথমবারের জন্য গবেষকদের নাগালে এসেছিল রহস্যময় এই মৌলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রশ্ন থেকে যায়, স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কীভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এই মৌলটির সঙ্গে?
না, যেটা ভাবছেন, তেমনটা নয়। আইনস্টাইন (Albert Einstein) এই মৌলের আবিষ্কারক নন। এমনকি এই মৌল আবিষ্কারের প্রক্রিয়াতেও কোনোভাবে জড়িত ছিলেন না তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর নামেই নামাঙ্কিত করা হয়েছিল এই মৌলটিকে। আর তা নিয়েই বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন গবেষকদের একাংশ।
গল্পটা শুরু থেকেই বলা যাক বরং। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতি পড়েছিল হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়াবহ বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়েই। ‘নিউক্লিয়ার কেপেবল স্টেট’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল আমেরিকা। তবে সর্বোত্তম হওয়ার দৌড় থেমে থাকেনি সেখানে। কারণ, এর কিছুদিন পরই পারমাণবিক অস্ত্রের নাগাল পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৯ সালে প্রথম পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা করে স্তালিনের দেশ। এরপরই বিশ্বের দুই সবচেয়ে বড়ো শক্তির মধ্যে শুরু হয়ে যায়, পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারকে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করে তোলার এক আশ্চর্য প্রতিযোগিতা। শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধের।
তবে শুধু অস্ত্র নির্মাণই নয়, একই সঙ্গে ঘাতক প্রযুক্তির অনুসন্ধানও চালিয়ে যায় বিশ্বের দুই শক্তিধর মেরু। পারমাণবিক বিভাজনের পর পারমাণবিক সংযোজনকে কীভাবে হাতিয়ারে বশীভূত করা যেতে পারে, তা নিয়েই শুরু গবেষণা। বলাই বাহুল্য এই ইঁদুরদৌড়ে সোভিয়েতের থেকে খানিকটা হলেও এগিয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই বিশ্বের প্রথম থার্মোনিউক্লিয়ার অর্থাৎ তাপপারমাণবিক অস্ত্র ‘মাইক’ তৈরি করেন আমেরিকার গবেষকরা। যা আমরা চিনি হাইড্রোজেন বোমা নামে।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাস। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের এনিউয়িটক অ্যাটল। এই ছোট্ট দ্বীপের নিকটবর্তী সমস্ত অঞ্চল খালি করিয়ে দেয় মার্কিন সেনারা। মৎস্যজীবীদের ওপর জারি করা হয় সাময়িক নিষেধাজ্ঞা। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে তখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পরমাণু পরীক্ষা করে ফেলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে যুদ্ধাভ্যাসের কথা বলা হলেও, ফের কোনো পরমাণু বোমার পরীক্ষণ করতে চলেছে তারা— অনুমান করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই এক নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে তা কেই বা জানত।
১ নভেম্বর। প্রথমবার বিশ্ব সাক্ষী হয় হাইড্রোজেন বোমার ভয়াল কীর্তির। বলতে গেলে গোটা দ্বীপপুঞ্জটাকেই বাষ্পীভূত করে ফেলেছিল তৎকালীন বিশ্বের ‘ঘাতকতম’ এই বোমা। প্রশান্ত মহাসাগরের আকাশে ছেয়ে ফেলেছিল প্রকাণ্ড এক মাশরুম ক্লাউড। যার উচ্চতা প্রায় ৩৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ, চার-চারটি এভারেস্ট পর পর দাঁড় করলে, তার থেকেও খানিক বেশি। সেইসঙ্গে এই মেঘ ঢেকে ফেলে ৫৭ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নথি অনুযায়ী, সবমিলিয়ে ১০.৪ মেগাটন শক্তি উৎপন্ন করেছিল এই বোমা। যা কিনা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার শক্তির থেকে কমপক্ষে ৫০০ গুণ বেশি!
দূর থেকে এই বীভৎস ধ্বংসলীলা ক্যামেরাবন্দি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি সোভিয়েতকে সতর্ক করতে তা দেখানো হয় টেলিভিশনেও। তবে সেখানেই থেমে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র। আশ্চর্য এই বোমা কতটা ঘাতক, তা জানতেই মাশরুম ক্লাউডের মধ্যে পাঠানো হয় তিনটি যুদ্ধবিমানকে। বিমানচালকদের দায়িত্ব ছিল ‘ক্লাউড স্যাম্পেল’ বা তেজস্ক্রিয় মেঘের নমুনা সংগ্রহ করে আনা। দুটি বিমান ফিরে এলেও, তেজস্ক্রিয় এই মেঘেই ‘হারিয়ে’ যান তৃতীয় পাইলট জিমি রবিনসন। আজও খাতায়-কলমে যিনি ‘নিখোঁজ’।
যাই হোক, এবার ফিরে যাওয়া যাক আইনস্টাইনিয়ামের প্রসঙ্গে। ঘাতক হাইড্রোজেন বোমা ‘মাইক’-এর মাশরুম ক্লাউড থেকে সংগৃহীত নমুনার বিশ্লেষণেই সন্ধান মিলেছিল দুটি নতুন মৌলের। দুটি মৌলই অতি-তেজস্ক্রিয় এবং অস্থিতিশীল। যাদের অর্ধজীবন বা হাফ-লাইফ মাত্র ২০-২১ দিন। অর্থাৎ, ২১ দিনের মধ্যেই এই মৌলের অর্ধেক পরমাণু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায় আপনা থেকেই। এই দুটি মৌলের প্রথমটিই আজ পরিচিত আইনস্টাইনিয়াম নামে, অন্যটির পরিচয় ফার্মিয়াম। যদিও আইনস্টাইনিয়াম নামটির জন্ম আরও বছর তিনেক পর।
আসলে পারমাণবিক পরীক্ষার ‘ক্লাসিফায়েড’ এই তথ্য কোনোভাবেই প্রকাশ্যে আনতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৫ সালে সুইডিস গবেষকরা এই একই মৌলের আবিষ্কারের কথা প্রকাশ্যে আনলে, কুলুপ খোলে আমেরিকা। সে-সময় প্রকাশ্যে আনা হয় অপেরাশন ‘আইভি মাইক’-এর ‘ক্লাসিফায়েড’ ফাইল। শেষ পর্যন্ত নোবেল কমিটি এই মৌল আবিষ্কারের স্বীকৃতি দিয়েছিল মার্কিনিদেরই। কিন্তু কী নাম রাখা হবে এই নতুন মৌল দুটির?
কয়েক মাস আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন কিংবদন্তি পদার্থবিদ স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে শেষ পর্যন্ত তাঁর নামেই নাম রাখা হয় ৯৯ পরমাণু ক্রমাঙ্ক বিশিষ্ট মৌলটির। যদিও ১৯৫২ সালে খাতায়-কলমে মার্কিন গবেষকরা গ্রিক শহর এথেন্সের নামানুসারে এই মৌলের নাম ‘এথেনিয়াম’। যাই হোক, অন্যদিকে আরেক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে ‘ফার্মিয়াম’ নাম রাখা হয় দ্বিতীয় মৌলটির। ফার্মিও প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে। পাশাপাশি তিনি জড়িতও ছিলেন ‘ম্যানহাটন প্রোজেক্ট’-এর সঙ্গে। ফলে, নোবেল কমিটির এই প্রস্তাবে খুব একটা আপত্তি তোলেনি যুক্তরাষ্ট্র।
অবশ্য ‘আইনস্টাইনিয়াম’-এর নাম নিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন বিজ্ঞানীদের একাংশ। তার কারণও খুব স্পষ্ট। পারমাণবিক বোমার তত্ত্বের সঙ্গে পরোক্ষাভাবে আইনস্টাইনের নাম জড়িয়ে থাকলেও, চিরকালই তিনি বিরোধিতা করেছেন এই ধ্বংসযজ্ঞের। পাশাপাশি ১৯৩৯ সালে নাৎসি জার্মানি যখন এই ঘাতক অস্ত্র তৈরির গবেষণা শুরু করেছিল, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে খোদ চিঠি লিখে সতর্ক করেছিলেন আইনস্টাইন। ফলত, এমন একটি ধ্বংসাত্মক আবিষ্কারের সঙ্গে তাঁর নাম জড়ানো কতটা নৈতিক— তা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। অবশ্য এসবের পরেও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে আইনস্টাইনিয়ামের নাম। আর আইনস্টাইনের সঙ্গে জুড়ে গেছে ঘাতক পারমাণবিক পরীক্ষার এক অন্ধকার অধ্যায়…
Powered by Froala Editor