১ নভেম্বর, ১৭৫৫। আর পাঁচটা দিনের মতোই কোলাহলে গমগম করছিল পর্তুগালের (Protugal) প্রাণকেন্দ্র লিসবন। কেউ যাচ্ছেন বাণিজ্য করতে, কেউ আবার অফিস-আদালতে, শহরের রাস্তায় খেলে বেড়াচ্ছে কচিকাচারা। তবে হঠাৎ করেই গোটা শহরের আকাশ ছেয়ে ফেলে অসংখ্য গাঙচিল। সমুদ্র ছেড়ে তারা উড়ে চলেছে মূল ভূখণ্ডের দিকে। ব্যাপারটা এতই আশ্চর্যজনক ছিল যে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলেন সকলেই। এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কেঁপে ওঠে মাটি। কয়েক তলা উঁচু জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে লিসবনের (Lisbon) মাথায়। মুহূর্তের মধ্যেই যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ইউরোপের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র।
হ্যাঁ, অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র বললে এতটুকু ভুল হয় না লিসবনকে। বলতে গেলে ব্রিটিশদেরও আগে প্রথম বৈশ্বিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল পর্তুগিজরাই। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা— চারটি মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিল তাদের প্রভাব। লিসবনের মাধ্যমেই বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সঙ্গে বাণিজ্য চলত পর্তুগালের। ফলে লিসবনের আয়ও মন্দ ছিল না। আয়তনের দিক থেকে অপেক্ষাকৃতভাবে ছোট হলেও, তৎকালীন বিশ্বের পঞ্চম জনবহুল শহর ছিল লিসবন। এমনকি বিশ্বের তৃতীয় ব্যস্ততম এবং সবচেয়ে ধনী বন্দরও ছিল লিসবনেই।
লিসবনের এই গৌরবই এক ঝটকায় ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছিল ১৭৫৫-এর সেই ‘ঘাতক’ সুনামি। প্রাণ নিয়েছিল কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষের। গবেষকদের মতে, ৩২ হাজার হিরোশিমা বোমার সমতুল্য শক্তিসম্পন্ন এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৯.২ রিখটার। এমনকি এখানেই শেষ নয়। এরপর গোটা লিসবন শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আগুন। ৪ সপ্তাহ ধরে জ্বলেছিল সেই লেলিহান শিখা। প্রকৃতির এই ধ্বংসলীলাই বদলে দিয়েছিল পর্তুগালের ইতিহাসকে। শুধু পর্তুগালই নয়, মানবসভ্যতার যাত্রাপথও রীতিমতো বদলে দেয় এই সুনামি। কিন্তু কীভাবে?
সেই প্রসঙ্গেই যাওয়া যাক বরং। আসলে আটলান্টিক মহাসাগরে তুলনামূলকভাবে শান্ত হওয়ায়, সুনামি প্রতিরোধের জন্য কোনো ব্যবস্থাই ছিল না লিসবনে। ফলে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল লিসবন। যা আর্থিকভাবে বড়োসড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায় পর্তুগালকে। একদিকে যেমন নতুন করে এই শহরের পরিকাঠামো গড়ে তোলা দায় হয়ে ওঠে প্রশাসনের কাছে, তেমনই লিসবন অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশের আয়ের একাংশ।
লিসবনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দায়িত্ব দেওয়া হয় পর্তুগালের পররাষ্ট্র সচিব মার্কুয়েস ডি পোম্বালকে। স্বৈরাচারী ভঙ্গিতেই নিষ্ঠুরভাবে বিশৃঙ্খলা দমন করেছিলেন তিনি। অবশ্য সেই অজুহাতে তাঁর ভালো কাজগুলিকেও ঢেকে ফেলা যায় না। পর্তুগালের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর, গবেষক এবং স্থপতিদের নিয়ে পোম্বাল গড়ে তুলেছিলেন একটি বিশেষ দল। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কীভাবে পাওয়া সম্ভব কিংবা ভূমিকম্প প্রতিরোধক বাড়ি কীভাবে নির্মাণ করা যায়— এসব জটিল ধাঁধাঁর সমাধান খুঁজে বার করাই ছিল তাঁদের প্রধান কাজ। হ্যাঁ, সাফল্যও এসেছিল বেশ। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়ার কোনোযন্ত্র তৈরি না হলেও, ভূমিকম্প পরিমাপের আদি যন্ত্র তৈরি হয়েছিল পর্তুগালেই। তৈরি হয়েছিল ভূমিকম্প প্রতিরোধক বাড়ির নকশাও। তাছাড়া লিসবন তখন শ্মশান। চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে মৃতদেহ। সেখান থেকে যাতে মহামারী ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন পোম্বাল।
অবশ্য এতকিছুর পরেও, ‘অত্যাচারী’ স্বভাবের কারণেই শেষ পর্যন্ত জনরোষের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। ১৭৭৭ সালে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয় পোম্বালকে। তবে পর্তুগালের হারানো গৌরব আর ফেরেনি কোনোদিনই। দুর্বল নেতৃত্ব, গৃহযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক বিপ্লব এবং আগ্রাসন ধীরে ধীরে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে তোলে পর্তুগিজ সাম্রাজ্যকে। এর মাঝেই উত্থান হয় ব্রিটিশদের।
তবে শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়। লিসবন ভূমিকম্পের প্রভাব ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। সে-সময় ধর্মীয় ব্যক্তিরা দাবি করেছিলেন, রাজার পাপেই এভাবে শাস্তি দিয়েছেন ঈশ্বর। এমনকি এও ধারণা করা হয়েছিল যে কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাস’-দের ওপর ক্রমাগত অত্যাচার চালিয়ে যাওয়াই এই ঘটনার কারণ। তা নিয়ে সরব হয়ে উঠেছিল গোটা দেশের মানুষ। যার ফলস্বরূপ লিসবন ভূমিকম্পের কয়েক বছরের মধ্যেই পর্তুগালে ইতি পড়ে দাসপ্রথার। শুধু পর্তুগাল নয়, ধীরে ধীরে এই প্রভাব দেখা যায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলিতেও।
অন্যদিকে এই ভূমিকম্প প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছিল সাধারণ মানুষকে। সে-সময় যখন পর্তুগিজ ধর্মযাজকরা ‘পাপ’-এর দোহাই দিয়ে রাজার থেকে ক্ষমতা আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন মানব জীবনে ঈশ্বরের প্রভাব কতটুকু— তা নিয়ে রীতিমতো ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছিল ইউরোপে। এমনকি লিসবন ভূমিকম্পে ঈশ্বরের হাত রয়েছে কিনা তা নিয়ে সরব হয়েছিলেন ভল্টেয়ার, রুশোর মতো দার্শনিকরাও। “হোয়াট আ গেম অফ চান্স হিউম্যান লাইফ ইজ”— ভল্টেয়ারের এই কিংবদন্তি মন্তব্য আসলে লিসবন ভূমিকম্প প্রসঙ্গেই। অর্থাৎ গোটা ইউরোপেই ছড়িয়ে পড়েছিল এই ভূমিকম্পের প্রভাব।
দেখতে গেলে লিসবন ভূমিকম্পের পর যেন জন্ম হয়েছিল এক নতুন পৃথিবীর। যেখানে ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রধান্য পেয়েছিল বিজ্ঞান, বদলে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ এবং যুক্তিবাদ…
Powered by Froala Editor