১৯৭৪ সাল। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সুইডিসদের মুখোমুখি হয়েছিল ডাচরা। না, সেই ম্যাচে গোলের খাতা খুলতে পারেনি কোনো দলই। প্রথমত গ্রুপ স্টেজের ম্যাচ, তার ওপর গোলশূন্য ড্র— ফুটবল ইতিহাস সেভাবে মনে রাখেনি সুইডিস বনাম ডাচদের এই সংঘাতকে। তবে ড্রিবলিং এবং টার্নিং-এর কথা উঠলে এই ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠে আসতে বাধ্য।
ম্যাচের বয়স তখন ২৪ মিনিট। বাঁ প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ শানিয়ে সুইডেনের বক্সের কাছে পৌঁছে গেছেন ডাচ তারকা ইয়োহান ক্রুয়েফ (Johan Cruyff)। তবে সুইডিসরাও ছাড়বার পাত্র নয়। তাঁর গায়ে লেগে রয়েছেন ২ নম্বর জার্সিধারী সুইডিস ডিফেন্ডার জঁ ওলসন। অথচ, খানিকটা মাইনাস করার ভঙ্গিতে সামনে এগিয়েই চকিতে বল নিয়ে ঘুরে গেলেন ক্রুয়েফ। সম্পূর্ণ ১৮০ ডিগ্রি। ক্রুয়েফের এই গতিময় টার্নিং এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল খেলা। ওলসন নিজে বুঝতেও পারেননি, তাঁকে কাটিয়ে বল নিয়ে বক্সের ভেতরে ঢুকে গেছেন ক্রুয়েফ। ফুটবলাররা তো বটেই, মাঠে উপস্থিত দর্শকরাও আশা করেননি এহেন মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে ফুটবলের মাঠে।
আধুনিক ফুটবলে এই ১৮০ ডিগ্রি টার্নিং (180 Degree Turning) আজ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি স্কিল। মেসিই হোক কি লুকা মডরিচ বা মাতেও কোভাচিচ— গতকাল আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচেও একাধিকবার দেখা গেছে এই শৈল্পিক স্কিল। তবে মজার বিষয় হল, বিশ্ব ফুটবলে এই স্কিলকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল ১৯৭৪-এর সেই ম্যাচই। এমনকি ফুটবলের পরিভাষায় এই বিশেষ স্কিলটির আনুষ্ঠানিক নামও ‘ক্রুয়েফ টার্নিং’। অবশ্য ক্রুয়েফকেই এই স্কিলের জনক বলা যায় কিনা, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। তবে ক্রুয়েফের আগে ফুটবলের ময়দানে এই স্কিলের ব্যবহার হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিত করার মতো কোনো তথ্যই লিপিবদ্ধ নেই ফুটবল ইতিহাসে।
তবে শুধু ক্রুয়েফই নন, ১৯৭৪-এর বিশ্বকাপে ডাচদের উত্থান তৈরি করেছিল এক আশ্চর্য কিংবদন্তি। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সেটাই ছিল ডাচদের প্রথম বিশ্বকাপ। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের আগে দুটি বিশ্বকাপে ডাচরা অংশ নিলেও, প্রথম ১০-এ জায়গা করে নিতে পারেনি তারা। অন্যদিকে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত টানা ছ’বছর বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনি ডাচরা। ফলে, ১৯৭৪-এর বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে যাবে ডাচ ব্রিগেড, এমনটা আশা করেনি কেউ-ই। তবে ডার্ক হর্স হয়েও ‘টোটাল ফুটবল’ এবং ক্রুয়েফের ‘পোয়েট্রি ইন মোশান’-এর ওপর ভর করেই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখায় ডাচরা।
গ্রুপ পর্বে বুলগেরিয়া ও উরুগুয়ে তো বটেই, দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও পূর্ব জার্মানি এই তিনটি দলকেই পর্যুদস্ত করেছিল ডাচরা। ফাইনালে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পশ্চিম জার্মানি। বিশ্বকাপের শুরুতে ফেভারিট না হলেও, ফাইনালে ধারে-ভারে সেবার এগিয়ে ছিল ডাচরাই। এমনকি বহু ফুটবল বিশেষজ্ঞই জানিয়েছিলেন, সেবারই হয়তো প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতবে নেদারল্যান্ডস। কেন-না, গ্রুপ পর্বে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়েছিল পূর্ব জার্মানি। আর তাদের ‘বধ’ করেই ফাইনালে ওঠা নেদারল্যান্ডসের।
ম্যাচের শুরুতেই ঝলসে ওঠেন ক্রুয়েফ। ম্যাচের বয়স তখনও এক মিনিট হয়নি। পায়ে একবারের জন্যও বল ঠেকাতে পারেনি জার্মানরা। ১৩টি নিখুঁত পাস এবং ম্যাজিক্যাল ড্রিবলিং করে জার্মান বক্সে ঢুকে পড়েন ক্রুয়েফ। নিশ্চিত গোল আটকে বক্সের মধ্যে ক্রুয়েফকে ফাউল করতে বাধ্য হয়েছিলেন জার্মান ডিফেন্ডার। পেনাল্টি পেয়েছিল নেদারল্যান্ডস।
মজার বিষয় হল, নিজে এই পেনাল্টি নেননি ক্রুয়েফ। বদলে সেট পিস নেওয়ার দায়িত্ব তুলে দেন সতীর্থ নিসকেনের কাঁধে। হ্যাঁ, ভুল করেননি তিনি। ২ মিনিটেই ম্যাচের লিড নিয়েছিল ডাচরা। তবে পরবর্তী ৯০ মিনিট সেই লিড ধরে রাখতে পারেনি তারা। ২৫ মিনিটে ম্যাচের সমতা ফেরায় পশ্চিম জার্মানি। এরপর ৪৩ মিনিটে ডাচদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন গার্ড মুলার।
ম্যাচের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেলেও স্কোরবোর্ডে আর পরিবর্তন আনতে পারেননি ক্রুয়েফ, নিসকেনরা। ২-১ গোলেই থেমে যেতে হয়েছিল ডাচদের। তবে এই অপ্রত্যাশিত হারের জন্য দায়ী স্বয়ং ক্রুয়েফ। এ-কথা সে-সময় চর্চিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। এমনকি বিশ্বকাপের পরেও। আসলে পরিসংখ্যান ও ইতিহাস বলছে, ক্রুয়েফ গোল করেছে এমন ম্যাচে একবারের জন্যেও হারেনি ডাচরা। সতীর্থ নিসকেনকে পেনাল্টি নেওয়ার দায়িত্ব না তুলে দিয়ে, ক্রুয়েফ নিজে সেই পেনাল্টি মারলে হয়তো সেদিনও জিতত ডাচ-বাহিনীই।
বার্সেলোনাই হোক কিংবা আয়াক্স— তৎকালীন ইউরোপের দুই কিংবদন্তি ক্লাবকেই একাধিক ট্রফি এনে দিয়েছেন ক্রুয়েফ। পেয়েছেন ঘরোয়া লিগ, কাপ থেকে শুরু করে ইউরোপিয়ান কাপ এবং আন্তর্মহাদেশীয় ট্রফি। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের তকমাও পেয়েছিলেন ১৯৭৪-এর বিশ্বকাপে। অথচ, পেলে পরবর্তী যুগের অন্যতম তারকা হয়েও, সামান্য ‘ভুল’ সিদ্ধান্তের জেরেই বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়নি ক্রুয়েফের…
Powered by Froala Editor