শহরের বুক চিরে এগিয়ে গেছে মিটার দশেক চওড়া খাল। কেউ সাঁতার কাটছেন সেখানে, আবার কেউ নৌকা বেয়ে এগিয়ে চলেছেন এই জলপথ ধরে। আর এই ছোট্ট খালের দু’ধারে গজিয়ে ওঠা অজস্র গাছগাছালি যেন ঢেকে দিয়েছে শহরের মূল কংক্রিটের কাঠামোকে।
নেদারল্যান্ডসের (Netherlands) উট্রেচট (Utrecht) শহর। প্রায় হাজার বছর পুরনো এই শহরে গেলেই দেখা যাবে এই আশ্চর্য দৃশ্য। ইউরোপ তো বটেই, বিশ্বের বুকে এহেন তথাকথিত ‘উন্নত’ অথচ পরিবেশবান্ধব শহর খুব কমই নজরে আসে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, আজ থেকে বছর দশেক আগেও উট্রেচটের বুকে ছিল না এই জলপথ। উট্রেচটকে ছায়া দিত না গাছগাছালির শামিয়ানাও। বরং, আর পাঁচটা উন্নত শহরের মতোই কংক্রিটের জঞ্জাল হয়ে উঠেছিল এই ওলন্দাজ শহরটি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে আকস্মিকভাবে তবে বদলে গেল কীভাবে এই শহরের চেহারা?
উত্তর দিতে গেলে ফিরে যেতে হবে একাদশ শতকে। সে-সময় নেদারল্যান্ডসে গড়ে উঠেছিল ছোটো ছোটো অসংখ্য রাজ্য। তেমনই এক জনপদ ছিল উট্রেচট। ৯০০ বছর আগে এই শহরে বহিঃশত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে গড়ে তোলা হয় প্রকাণ্ড পরিখা। আজ উট্রেচটের বুকে যেখান দিয়ে প্রবাহিত হয় ‘উট্রেচট ক্যানাল’-খ্যাত খালটি, সেটিরই আদি রূপ ছিল এই পরিখা। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই গুরুত্ব কমতে থাকে এই খালের।
বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিকভাবে উন্নয়নের ওপরই জোর দিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। সে-সময় বিভিন্ন জাতীয় প্রকল্পের দৌলতে দ্রুত বদলাতে শুরু করে উট্রেচটের ছবি। শহরজুড়ে গড়ে ওঠে একাধিক কলকারখানা। কেটে ফেলা হয় বহু গাছ। এমনকি ক্রমাগত গাড়ির ব্যবহার বাড়তে থাকায়, ১৯৭০-এর দশকে ওলন্দাজ প্রশাসন ঠিক করে, বুজিয়ে ফেলা হবে আস্ত খাল।
যেমন পরিকল্পনা তেমনই কাজ। মিটার দশেক প্রশস্ত খালটি তো বটেই, তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলও ঢেকে ফেলা হয়েছিল কংক্রিটের মোড়কে। গড়ে তোলা হয়েছিল ১২ লেনের প্রকাণ্ড রাজপথ। এই পথ যে নেদারল্যান্ডসের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বিশেষ অবদান রেখেছিল, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে তার মূল্যও দিতে হয়েছিল মানুষকে।
এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের জেরে ক্রমশ বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে শহরজুড়ে। প্রভাব পড়েছিল স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রেও। শহর থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে পাখিরা। সেইসঙ্গে গ্রীষ্মে তাপপ্রবাহের সমস্যাতেও নাভিশ্বাস উঠেছিল স্থানীয়দের। ফলে, কয়েক দশকের মধ্যেই উট্রেচটের মানুষ উপলব্ধি করেছিলেন সংরক্ষণ প্রয়োজন প্রকৃতির।
২০০২ সাল। গণভোটের মাধ্যমেই শহরের বুকে জলপথ প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন উট্রেচটের মানুষ। ঠিক হয়, শহরের কেন্দ্রে গড়ে তোলা হবে আস্ত একটি বাগানও। কিন্তু সেই বাগান ও জলপথ তৈরির মতো জায়গা কোথায়? তবে কি উচ্ছেদ করা হবে স্থানীয়দের? বন্ধ করে দেওয়া হবে কলকারখানা? শেষ পর্যন্ত সমাধান খুঁজে দেয় উট্রেচট পৌরসভা। জানায়, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে ১২ লেনের রাস্তাটিকে। বদলে সেখানেই গড়ে তোলা হবে উট্রেচট খাল। তাতে যেমন সংরক্ষিত হবে ঐতিহ্যবাহী রূপ, তেমনই বাঁচবে প্রকৃতি।
বেশ কয়েক বছর লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকলেও, ২০১৫ সালে শুরু হয় এই সংরক্ষণ প্রকল্প। ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই ধাপে চলেছিল এই কর্মযজ্ঞ। বাকিটা ইতিহাস। আজ এই জলপথ ও তার সংলগ্ন একফালি সবুজ বাগানই যেন ট্রেডমার্ক হয়ে উঠেছে এই ডাচ শহরের। ধীরে ধীরে শহরে ফিরেছে পাখিরাও। কমেছে দূষণের পরিমাণ, এমনকি গাড়ির ব্যবহারও। বর্তমানে গণপরিবহন এবং সাইকেলেই ভরসা রাখেন উট্রেচটের অধিকাংশ মানুষ।
একটা সময় বাংলার বুকেও প্রবাহিত হত অজস্র খাল, নদী। বাণিজ্য চলত জলপথে। গণ-পরিবহনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত কলকাতা তথা বাংলার খালবিল। তবে নগরায়নের দৌলতে সে-সব আজ অতীত। বেড়েছে দূষণ। সেইসঙ্গে গরমে হাঁসফাঁস করছে গোটা শহরের মানুষজন। এমত পরিস্থিতিতে জলপথ ও পরিবেশ সংরক্ষণ যে প্রয়োজনীয় তা বলার অপেক্ষা থাকে না। সুপরিকল্পিত নগরায়নের মধ্যে দিয়েও যে পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তা-ই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে উট্রেচট। এখন প্রশ্ন, আদৌ কি সে-পথে হাঁটবে আমাদের প্রশাসন?
Powered by Froala Editor