“ঘরে বসেই গুগল আর্থ খুলে যদি পৌঁছে যা দেবলগড় অঞ্চলে, দেখবেন সেখানে একট বড় দুর্গের অবশেষ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার চারপাশ ঘিরে চওড়া পরিখা। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, দুর্গের চারটি কোণে আছে ৭০-৮০ ফুট উঁচু চারটি ঢিবি। যেগুলো একসময় ওয়াচটাওয়ার হিসাবে কাজ করত।” বলছিলেন বিশ্বজিৎ রায়। পেশায় ভূগোলের গবেষক। নদীয়ায় এসেছিলেন বাংলার হারিয়ে যাওয়া নদনদী নিয়ে গবেষণা করতে। তারপর কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন ইতিহাসের সঙ্গে? প্রহরকে শোনালেন সেইসব গল্পই।
প্রথম গবেষণা করতে করতে বিশ্বজিৎবাবু জানতে পারলেন, একসময় গাংনাপুর থানার এই অঞ্চল দিয়েই বয়ে যেত গঙ্গার একটি মূল প্রবাহ। সেই প্রবাহের সূত্র ধরে চলত ব্যবসাবাণিজ্যও। সেসব আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগের কথা। কেবল কিছু প্রাচীন গ্রন্থে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তারপর নদী সরে গিয়েছে। কিন্তু ইতিহাসকে ছড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। বিশ্বজিৎবাবু দেখতেন জঙ্গলের মধ্যে উঁচু পিলারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মাটির ঢিবিগুলিকে। আর মাঝেমধ্যেই খবর পেতেন, ঘরবাড়ি তৈরির সময় বা কৃষিকাজের সময় মাটির নিচ থেকে নানা পুরনো জিনিস উঠে আসছে। গ্রামবাসীরা তার মর্ম বোঝেননি। কিন্তু বিশ্বজিৎবাবু স্থির করেছিলেন, এই ইতিহাসকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। আর সেই থেকেই জড়িয়ে পড়া ইতিহাস সংরক্ষণের কাজে।
নদীয়া জেলার গাংনাপুর থানার দেবগ্রাম পঞ্চায়েতের দেবলগড়। কত পুরনো এই প্রত্নক্ষেত্র? বিশ্বজিৎবাবু জানালেন, এখান থেকেই পাওয়া গিয়েছে গুপ্ত-পূর্ববর্তী যুগের অসংখ্য নমুনা। গুপ্তযুগের অসংখ্য মুদ্রা ও শিলালিপি তো আছেই। আর পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন রোমান পানপাত্র বা অ্যাম্ফোরা। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে আর কোথাও অ্যাম্ফোরা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরও কী কী যে আছে, সেসবের মূল্যায়ন করতে সত্যিই একজন বিশেষজ্ঞের দরকার। “তবু আমার আক্ষেপ প্রত্নক্ষেত্র হিসাবে দেবলগড় তার উপযুক্ত মর্যাদা পাচ্ছে না।” বলছিলেন বিশ্বজিৎ রায়।
আরও পড়ুন
কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তার সঙ্গে জড়িয়ে বর্গি আক্রমণের ইতিহাস
তবে বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে আসার আগেই এগিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ। এখন রানাঘাট এলাকার কোথাও মাটি খুঁড়তে গিয়ে কোনো প্রাচীন নমুনা খুঁজে পাওয়া গেলেই ডাক পড়ে বিশ্বজিৎবাবুর। দেবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতেরই একজন ব্যক্তি তাঁর বাড়িতে তৈরি করে দিয়েছেন একটি সংগ্রহশালা। পরিচর্যাও করেন গ্রামের মানুষই। এই সংগ্রহশালায় যদিও অনেক বিশিষ্ট মানুষই এসেছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির আধিকারিকরা এসেছিলেন। তাঁরা মান্থলি জার্নালে লিখেছিলেন বাংলার প্রত্ন-পর্যটন মানচিত্রে দেবলগড় নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। পুরাতত্ত্ব বিভাগের আধিকারিকরাও এসেছেন। দেখে গিয়েছেন। গবেষণার জন্যও আসেন অনেকে। যোগাযোগ করা হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গেও। তবে বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, “শুকনো আশ্বাস ছাড়া সেখান থেকে আর কিছুই মেলেনি।”
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম ডাকঘর মেদিনীপুরের খেজুরিতে, সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকছে ইতিহাস
আরও পড়ুন
ভূতচতুর্দশীতে আজও তৈরি হয় পেত্নীর মূর্তি; ঐতিহ্যের আড়ালে প্রেতচর্চার ইতিহাস?
পাল ও সেন যুগের যে বিপুল সমৃদ্ধি, তারই যেন একটা নমুনা ধরা রয়েছে দেবলগড়ে। বৌদ্ধ তারা মূর্তি যেমন পাওয়া গিয়েছে, তেমনই পাওয়া গিয়েছে বিষ্ণুমূর্তিও। এমনকি উৎখননের ফলে একটা আস্ত বৌদ্ধবিহার পাওয়া গেলেও আশ্চর্য হবেন না বিশ্বজিৎ রায়। এখন শুধু তিনি তাকিয়ে আছেন, কবে কোনো দক্ষ খননকারী দল এই কাজে এগিয়ে আসবেন। এক দশক তো কেটে গেল ইতিহাস খুঁজে খুঁজে। তবে একদিন নিশ্চই আসবেন কেউ। আর দেবলগড়ের প্রকৃত ইতিহাসও উঠে আসবে। সঙ্গে উঠে আসবে বাংলার অজানা ইতিহাস।
Powered by Froala Editor