নাচতে-নাচতেই মৃত অসংখ্য মানুষ! মহামারী, না অন্য রহস্য?

রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু…’ রূপক হিসাবেই এ-কথা লিখেছিলেন তিনি। তবে এই পঙক্তির দ্বিতীয় অংশটা সত্যি হয়ে গিয়েছিল বাস্তবেও। নাচতে নাচতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। না, হেঁয়ালি নয়। করোনা, ইবোলা কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর মতো ষোড়শ শতকে এমনই এক অদ্ভুত মহামারীর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্সে। যা পরিচিত ডান্সিং প্লেগ (Dancing Plague) নামে। 

শুরু থেকেই বলা যাক এই ঘটনার কথা। ১৫১৮ সাল সেটা। তখন রীতিমতো গরম কাল ফ্রান্সে (France)। এক পড়ন্ত বিকালে হঠাৎ করেই ফ্রান্সের শহর স্ট্রাসবার্গের রাস্তায় নাচতে দেখা যায় এক ফরাসি গৃহবধূ ফ্রাউ ট্রোফিয়াকে। ব্যাপার কী? গৃহবধূর এ-হেন ধিঙ্গিপনা-কে ভালো চোখে দেখেননি অনেকেই। আবার কেউ কেউ বেশ আগ্রহের সঙ্গেই উপভোগ করতে থাকেন তাঁর নাচের দৃশ্য। কিন্তু কী কারণে নাচছেন তিনি? রহস্য সেখানেই। 

বিকেল গড়িয়ে, সন্ধে নামল শহরে, তারপর রাত। পরদিন সকালেও নাচ থামল না ট্রোফিয়ার। এদিকে বাড়ির লোকেরা চেষ্টা করেও তাঁকে ঘরে নিয়ে যেতে ব্যর্থ। এরই মধ্যে একটু একটু করে নাটকীয়ভাবে বদলাতে থাকল পরিস্থিতি। ট্রোফিয়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে নাচতে শুরু করলেন আরও বেশ কিছু মানুষ। দিন দুয়েকের মধ্যে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াল চল্লিশের কাছাকাছি। যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ফরাসি তরুণী। কারোরই খাওয়া-দাওয়া, স্নান করার বালাই নেই। মুখে কথাও নেই কোনো। শুধু অদ্ভুত এক লয়ে নেচেই চলেছেন তাঁরা। রক্তাক্ত সারা পা। ফুলে গেছে পায়ের মালাইচাকিও। তবে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই কারোরই। কখনও কখনও নাচতে নাচতেই অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ছেন মাটিতে। সম্বিত ফিরলে উঠেই আবার নাচ। 

আজকের দিনে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে তড়িঘড়ি পদক্ষেপ নেবে প্রশাসন, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে ষোড়শ শতকের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তখন আবার ফ্রান্স রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনাকে মজার ছলেই নিয়েছিলেন মধ্যযুগীয় শাসকরা। শহরের বুকে তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল নাচের মঞ্চ। ধরে বেঁধে সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয় নৃত্যরত নাগরিকদের। সঙ্গীতশিল্পী ও যন্ত্রবাদকদেরও ব্যবস্থা করেন শাসকরা। তবে এর পরিণতি হয় আরও ভয়ঙ্কর। 

আরও পড়ুন
‘মিথ্যে মহামারী’ তৈরি করে ৮ হাজার ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন পোলিশ চিকিৎসক

সপ্তাহখানেকের মধ্যেই শুরু হয় গণমৃত্যুর ঘটনা। ততদিনে নৃত্যরত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪০০-র গণ্ডি। এদিকে গড়ে প্রায় ১৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়ে চলেছে প্রতিদিন। একটানা নাচতে নাচতেই আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। 

আরও পড়ুন
যুদ্ধ, মহামারী, অভিবাসনে অশান্ত গোটা বিশ্ব; ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে মানব সভ্যতা?

না, সে-সময় এই মহামারীকে কোনো অসুখ বলেই মনে করেননি তৎকালীন শাসকরা। বরং, ধারণা ছিল কোনো প্রেতাত্মাই ভর করেছেন এই মানুষগুলোর ওপর। আবার তৎকালীন সময়ের সাহিত্যে কোথাও কোথাও এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যু হিসাবে। ধর্মীয় কারণে নাচতে নাচতেই নাকি স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেছিলেন মানুষরা। প্রশ্ন থেকে যায়, শেষ পর্যন্ত কীভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল এই মহামারী? 

আরও পড়ুন
জীবন্মৃত অবস্থায় কাটত দিন; ১০০ বছর আগের ‘জম্বি’ মহামারীর রহস্য মেটেনি আজও

পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে নড়ে চড়ে বসে স্ট্রাসবার্গ প্রশাসন। প্রেতাত্মার দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হাত-পা বেঁধে অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল নৃত্যরত মানুষদের। তাতে রোগের প্রতিকার না হলেও, বন্ধ হয় সংক্রমণ। তবে মাস দুয়েকের এই তাণ্ডবনৃত্য কম করে হলেও কয়েকশো মানুষের প্রাণ নিয়েছিল ফ্রান্সে। এমনটাই জানায় তৎকালীন সাহিত্য। কিন্তু আদতে কি তাই? এমন একটি ভয়াবহ ঘটনার ভিত্তিটাই অলৌকিক?

আধুনিক গবেষণা জানাচ্ছে, যা নাচ হিসাবে মনে করেছিলেন সেইসময়ের মানুষজন, তা আদৌ নাচ নয়। কোনো তাল, লয় ছাড়াই বিশৃঙ্খলভাবে হাত-পা ছোঁড়া। অনেকটা খিঁচুনির মতোই। এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল একটি বিশেষ প্রজাতির ছত্রাকের সংক্রমণে। এরগোট গোত্রের এই ছত্রাক খাদ্যদ্রব্য বিশেষত রুটির মধ্যে জন্ম নেয় স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে। এরগোট সংক্রমিত রুটি খাওয়ার কারণেই এই অদ্ভুত স্নায়বিক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে ফ্রান্সে। এবং এই রোগ ছোঁয়াচে হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই মহামারীর রূপ নেয় পরিস্থিতি। যদিও এই সবটাই অনুমান। এই তথ্য নিশ্চিত করার মতো উপযুক্ত প্রমাণ আজও অনুপস্থিত গবেষকদের হাতে। অনুপস্থিত সঠিক পরিসংখ্যানও। শুধু সমসাময়িক সাহিত্য এবং নথিতেই উল্লেখ পাওয়া যায় এই ঘটনার। পরবর্তীতে মাদাগাস্কার-সহ আরও ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি অঞ্চলে দেখা গিয়েছিল এই রোগের প্রাদুর্ভাব। তবে চারশো বছর পেরিয়ে এসে আজও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে এই অদ্ভুত রোগের অদ্ভুত রহস্য…

Powered by Froala Editor